Views Bangladesh Logo

ঋতুদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন এবং বাস্তবতা

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

রও একটি অর্জন- নারী ফুটবল দল প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে পা রাখল। ঐতিহাসিক এ অর্জনের পর উচ্ছ্বাসে ভাসছেন নারী ফুটবলাররা। আবেগ, উচ্ছ্বাসে অনেকেই তো এখনই ঋতুপর্ণা চাকমাদের নিয়ে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নও দেখছেন। বাংলাদেশ কি আদৌ বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় আছে!

প্রথমে দেখে নেওয়া যাক কোন প্রক্রিয়ায় নারী বিশ্বকাপে পৌঁছানো সম্ভব। ২০২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী এএফসি নারী এশিয়ান কাপ। আসরটি নারী বিশ্বকাপের বাছাই প্রতিযোগিতাও। এশিয়ান কাপ থেকে বিশ্বকাপের টিকিট পেতে হলে প্রথমত, গ্রুপ পর্ব টপকে পরের রাউন্ডে যেতে হবে। তিন গ্রুপের শীর্ষ দুটি করে দলের সঙ্গী হয়ে পরের রাউন্ডের টিকি পাবে তৃতীয় স্থানে থাকা তিন দলের মধ্য থেকে সেরা দুটি। আট দলের কোয়ার্টার ফাইনালের বিজয়ী চার দেশ সরাসরি বিশ্বকাপ খেলার টিকিট পাবে। হেরে যাওয়া দলগুলো যাবে প্লে-অফ লড়াইয়ে। সে লড়াইয়ে জয়ী দুই দলও বিশ্বকাপের টিকিট পাবে। প্লে-অফ লড়াইয়ে হেরে যাওয়া দল দুটিও বিশ্বকাপের টিকিটের জন্য আরেক দফা সুযোগ পাবে- আন্তঃ-মহাদেশীয় প্লে-অফের মাধ্যমে। সে লড়াইয়ে জিতলে মিলবে বিশ্বকাপের টিকিট।

ওপরের সমীকরণে পরিষ্কার- ২০২৭ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফিফা নারী বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে ন্যূনতম ৬ দল। আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফ জিতলে সংখ্যাটা সর্বোচ্চ ৮-এ উন্নীত হতে পারে। এটা বলার অবকাশ রাখে না যে, উত্তর কোরিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও চাইনিজ তাইপের মত নারী ফুটবলে এশিয়ার শক্তিশালী দলগুলো দৌড়ে এগিয়ে থাকবে। যে আট দেশের নাম উল্লেখ করা হল, সব কিন্তু ফিফা র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ ৫০-এ আছে। যার মধ্যে আছে র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ দশে থাকা জাপান (৭) ও উত্তর কোরিয়াও (৯)।

এবার দেখে নেওয়া যাক, বিশ্বকাপ খেলতে হলে বাংলাদেশকে কি করতে হবে। ২৯ জুলাই সিডনির টাউন হলে হবে এএফসি নারী এশিয়ান কাপের ড্র। ড্রয়ের ক্ষেত্রে দেশগুলোকে চারটি পাত্রে বিভক্ত করা হবে। প্রতি পাত্র থেকে একটি করে দেশ তিন গ্রুপের প্রতিটিতে যাবে। প্রতিযোগিতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এবার ড্র-এর পাত্র বিন্যাস করা হবে ফিফা র‍্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, এএফসি নারী এশিয়ান কাপে খেলবে ১২ দেশ। যার মধ্যে ১১ দেশ এরই মধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। আরেক দেশ টিকিট পাবে বাছাইয়ের ‘এ’ গ্রুপ থেকে। সেই গ্রুপের খেলা শেষ হবে ১৯ জুলাই। ‘এ’ গ্রুপের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ইরান কিংবা জর্ডানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা, যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে। সে অলৌকিকতার ছোঁয়া না পেলে মূল পর্বের র‍্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে সবার পেছনে থাকবে বাংলাদেশ। যার অর্থ লাল-সবুজরা থাকবে চতুর্থ পাত্রে।

প্রথম পাত্র থেকে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া কিংবা বিশ্ব নারী ফুটবলের দুই পরাশক্তি জাপান অথবা উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যেকোনো একটি দেশকে পাবে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় পাত্রে থাকা চীন, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মধ্যে যে কোনো একটি দেশকেও প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে লাল-সবুজরা। তৃতীয় পাত্র থেকে ফিলিপাইন, চাইনিজ তাইপে কিংবা উজবেকিস্তানের মধ্যে একটি দেশকে গ্রুপ সঙ্গী হিসেবে পাবে বাংলাদেশ। যার অর্থ টানা দুটি সাফ জয়ী দেশটি যাদের প্রতিপক্ষ পক্ষ হিসেবে পাচ্ছে, তাদের মধ্যে র‍্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে সবচেয়ে দুর্বল দেশ উজবেকিস্তান (৫১)। বাংলাদেশের বর্তমান র‍্যাংকিং ১২৮। সে হিসেবে গ্রুপের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দল কিন্তু বাংলাদেশ।

র‍্যাংকিং কেবলই একটা সংখ্যা, এটা সবসময় মাঠের লড়াইয়ে প্রভাব ফেলতে পারে না। এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশও সেটা প্রমাণ করেছে—ফিফা র‍্যাংকিংয়ে ৫৫ নম্বরে থাকা বাছাইয়ের ‘সি’ গ্রুপের আয়োজক মিয়ানমার এবং ৯২ নম্বরে থাকা বাহরাইনকে টপকে মূল পর্বের টিকিট নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ (১২৮)। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সকল ক্ষেত্রেই কি র‍্যাংকিংয়ের হিসেব মাঠের লড়াইয়ে গিয়ে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব? যারা গভীরভাবে ফুটবলের খবর রাখেন, তারা একবাক্যে বলবেন—‘না’। ২০২৪ সালে যার প্রমাণ দিয়ে গেছে চাইনিজ তাইপে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুটি প্রীতি ম্যাচে ৩১ মে ৪-০ এবং ৩ জুন ১-০ গোলে স্বাগতিকদের হারিয়েছে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে ৪২ নম্বরে থাকা দেশটি; যারা নারী এশিয়ান কাপ ড্রয়ের তিন নম্বর পাত্রে রয়েছে।

নারী এশিয়ান কাপের ড্রয়ে তিন নম্বর পাত্রে থাকা চাইনিজ তাইপের কাছে ঘরের মাঠে টানা দুই ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। ভাবুন এক এবং দুই নম্বরে পাত্রে থাকা আরও শক্তিশালী দেশগুলোর বিপক্ষে পরিস্থিতির কেমন হতে পারে! সন্দেহ নেই সেখানে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে পিটার বাটলারের বাংলাদেশ দলকে। নারী ফুটবলে শক্তিধর একাধিক দেশকে টপকে লাল-সবুজদের বিশ্বকাপ মঞ্চে পা রাখাটা হবে অলৌকিকই। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সংক্রান্ত স্বপ্নটা আপাতত বাস্তবসম্মত নয়। বরং এশিয়ার মঞ্চে পা রাখা লাল-সবুজদের উচিত বর্তমান অবস্থান মজবুত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া। সেটা করতে পারলে একটা সময় বিশ্বকাপ আর স্বপ্ন থাকবে না, ধরা দেবে বাস্তবে।

এশিয়ার পিছিয়ে থাকা জনপদ থেকে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার শীর্ষ ১২ দেশের মধ্যে উঠে এসেছে। এটা দারুণ কৃতিত্বের। কৃতিত্বপূর্ণ এ কাজ যতোটা কঠিন ছিল, তার চেয়ে বহুগুণ কঠিন এশিয়ার শীর্ষ ১২ দেশের মধ্যে থেকে আরও উন্নতি করা। এ জন্য প্রথমে প্রয়োজন শক্তিশালী ঘরোয়া কাঠামো। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, দেশের নারী ফুটবলের কোন কাঠামোই তো নেই। সর্বশেষ লিগ হয়েছে ২০২৩-২৪ মৌসুমে। এক মাসের কম সময়ে শেষ হয়েছে ৯ দলের লিগ। ৩৬ ম্যাচে হয়েছে ২০০ গোল। ম্যাচ প্রতি গোল গড় ৫.৫৬। অর্ধ-ডজন ম্যাচে দেখা গেছে গোল উৎসব। ম্যাচগুলোর স্কোর-লাইন ছিল ১৯-০, ১৭-০, ১৩-০, ১১-০, ১০-০ এবং ১০-০। ওপরের পরিসংখ্যানগুলো নিশ্চয় শক্তিশালী লিগের পরিচয় বহন করছে না।

দুর্বল এ লিগটাও কিন্তু নিয়মিত নয়। এ কারণে বাংলাদেশের সিনিয়র নারী ফুটবলারদের ভুটান লিগে খেলতে দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে পিছিয়ে থাকা ভুটানেও কিন্তু নারী লিগ জমজমাট। দেশটির ক্লাব এশিয়ান ফুটবল সংস্থার (এএফসি) ক্লাব কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করছে। যা ভুটানের নারী ফুটবলকে মন্থর গতিতে হলেও এগিয়ে আসতে সহায়তা করছে। এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ‘এ’ গ্রুপের লড়াইয়ে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ৩-২ গোলের জয় দেশটির অগ্রগতির প্রমাণ।

নারীদের ঘরোয়া লিগের পরবর্তী সংস্করণ কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে- এ নিয়ে সন্দিহান খোদ ফুটবল নিয়ন্তারাই! এ অবস্থায় শোনা যাচ্ছে নারীদের ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগ আয়োজনের গুঞ্জন। এ লিগ আয়োজন করতে গিয়ে নারী ফুটবল উন্নয়ন না ব্যবসা কোনটা প্রাধান্য পাবে- বলা মুশকিল! বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) বর্তমান কমিটি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নানা কর্মকাণ্ডে ব্যবসাই প্রাধান্য পেয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগ নারী ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার টনিক হলে বাংলাদেশ এশিয়ার মঞ্চে থিতু হবে। ফুটবলামোদিরা সে প্রত্যাশাই করছেন।

ঘরোয়া শক্তিশালী কাঠামো না থাকার পরও বাংলাদেশের নারী ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছে। এ অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর—প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বালক ও বালিকা বিভাগে দেশব্যাপী প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে। যে কারণে তৃণমূলে বেশ সচল দেশের নারী ফুটবল। এ প্রতিযোগিতাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে নারী ফুটবল একাডেমি। প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতা এবং একাডেমি সিঁড়ি বেয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ফুটবলার আসছেন বিকেএসপির নিবিড় পরিচর্যার আওতায়। সেখান থেকে সেরাদের উন্নত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসছে বাফুফে।

একাডেমি থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিযোগিতার পর বিকেএসপি এবং পরবর্তীতে বাফুফের উন্নত প্রশিক্ষণ- পুরো কার্যক্রমের মাঝে যদি ঘরোয়া প্রতিযোগিতা এবং লিগ যুক্ত করা হয়; দেশের নারী ফুটবল শক্তিশালী কাঠামোর ওপর দাঁড়াবে। যা এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ে আরও উন্নতির পথ সুগম করবে। ঘরোয়া কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে না পারলে উন্নয়নের ধারা নির্দিষ্ট একটা জায়গায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পরবে বলেই মনে করছেন ফুটবল বোদ্ধারা।

মাহবুব সরকার: লেখক সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ