যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলবে
২০২৫ সালের ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১০৮টি দেশের ওপর ১১ শতাংশ থেকে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত পারস্পরিক শুল্ক (Reciprocal Tariff) আরোপের ঘোষণা দেন। এটি বিশ্বের সব দেশের জন্যই এক ধরনের ধাক্কা হিসেবে এসেছে তা দেশটির বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ যতই হোক না কেন কিংবা সেই দেশের অর্থনীতির আকার যত বড় বা ছোট হোক না কেন। এখনো পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯১৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মোট রপ্তানি ছিল ৩ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আমদানি ছিল ৪ দশমিক ১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই সেবা খাতে কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। প্রমাণস্বরূপ ২০২৪ সালে সেবা রপ্তানি ছিল ১ দশমিক ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ছিল শূন্য দশমিক ৮৪১ ট্রিলিয়ন ডলার। তবে যুক্তরাষ্ট্র কোথাও সেবা খাতকে উল্লেখ করেনি অথচ বিশ্বব্যাপী সেবা রপ্তানি দ্রুত বাড়ছে এবং ভবিষ্যতের বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তবে এই পারস্পরিক শুল্কারোপ শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়- এটি তার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শর্ত আরোপ করেছে, যেমন: বাণিজ্য, অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা, করব্যবস্থা, চিকিৎসা উপকরণ ও ওষুধ, খাদ্যদ্রব্যের অবশিষ্টমাত্রা (MRL), উদ্ভিদ ও উদ্ভিজ্জ পণ্য, আমদানি লাইসেন্স, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশন, মেধাস্বত্ব, সেবা ও বিনিয়োগ, কৃষি, শ্রম এবং পরিবেশ ইত্যাদি। বাংলাদেশের জন্য এই নীতিমালাগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও কাঠামোগত সংশোধন প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমানে একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা অন্যদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি। এই দ্বিমুখী অস্থিরতা বাংলাদেশকে নতুন চ্যালেঞ্জের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
যেসব আলোচনা হয়েছে তার অনেকটাই অনির্ধারিত এবং প্রকাশযোগ্য নয়, ফলে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত এখনো অন্ধকারেই আছে এবং তারা তাদের বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করতে পারছে না। আবার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক চুক্তি স্থগিতও রাখা হচ্ছে। বেশ কিছু সংস্থা যদিও কিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আলোচনা করেছে, তবে তার ফলাফল আশানুরূপ নয়। তবে কিছু দেশ তাদের শুল্ক হ্রাস করতে পেরেছে এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশে তা হয়নি এবং বেসরকারি খাত এখনো একা।
প্রথম ধাপে ২ এপ্রিল শুল্ক আরোপের পর তিন মাস বিরতির পর দ্বিতীয় দফায় আবারও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়, এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের চিঠি পাঠান; কিন্তু এবার শুল্কের হার ভিন্ন এবং এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম ধাপের পর দেশগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার ভিত্তিতেই দ্বিতীয় দফার শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে।
নিম্নলিখিত দেশের দ্বিতীয় দফার শুল্ক হারের কিছু উদাহরণ: আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ (৩০ শতাংশ), বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ (৩৭ শতাংশ), বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার ওপর ৩০ শতাংশ (৩৫ শতাংশ), ব্রুনেইর ওপর ২৫ শতাংশ (২৪ শতাংশ), কম্বোডিয়ার ওপর ৩৬ শতাংশ (৪৯ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ (৩২ শতাংশ), ইরাকের ওপর ৩০ শতাংশ (৩৯ শতাংশ), জাপানের ওপর ২৫ শতাংশ (২৪ শতাংশ), কাজাখস্তানের ওপর ২৫ শতাংশ (২৭ শতাংশ), লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ (৪৮ শতাংশ), লিবিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ (৩১ শতাংশ), মালয়েশিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ (২৪ শতাংশ), মলডোভার ওপর ২৫ শতাংশ (৩১ শতাংশ), মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ (৪৪ শতাংশ), ফিলিপাইনের ওপর ২০ শতাংশ (১৭ শতাংশ), সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ (৩৭ শতাংশ), দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ (৩০ শতাংশ), দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ (২৫ শতাংশ), শ্রীলঙ্কার ওপর ৩০ শতাংশ (৪৪ শতাংশ) এবং থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ (৩৬ শতাংশ) হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যেখানে বন্ধনীতে প্রথম ঘোষিত হারের তুলনায় বর্তমান হারের পার্থক্য দেখানো হয়েছে। বেশিরভাগ দেশ আগের তুলনায় ২ শতাংশ-৫ শতাংশ ছাড় পেয়েছে, তবে কিছু দেশের ক্ষেত্রে এই ছাড়ের পরিমাণ আরও বেশি। যেমন:
শ্রীলঙ্কা: ৩০ শতাংশ → ৪৪ শতাংশ → ১৪ শতাংশ ছাড়
লাওস: ৪০ শতাংশ → ৪৮ শতাংশ → ৮ শতাংশ ছাড়
মলডোভা: ২৫ শতাংশ → ৩১ শতাংশ → ৬ শতাংশ ছাড়
এই ছাড়গুলো হয়তো নির্ভর করেছে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ, দেয়া ছাড়ের প্রস্তাব বা দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার ওপর এবং এই নির্দিষ্ট আকর্ষণীয় প্রস্তাবগুলো তাদের অধিক সুবিধা দিয়েছে।
২ এপ্রিল মার্কিন শুল্কারোপ ঘোষণার পর ৭ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে তিন মাস সময় চেয়ে নেন। চিঠিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা, গম, ভুট্টা, সয়াবিন আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় এবং মার্কিন কৃষকদের উপার্জন বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়। মার্কিন সুতার জন্য পৃথক চুক্তিবদ্ধ সংরক্ষণাগার সুবিধা দেয়ার প্রস্তাবও দেয়। এমনকি বাংলাদেশ চিঠিতে এও জানায় যে, বেশিরভাগ মার্কিন পণ্যের ওপর দক্ষিণ এশিয়ায় স্বল্প শুল্ক আরোপ করা হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ধাতব স্ক্র্যাপ ও কৃষি পণ্যের ওপর শুল্ক শূন্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় বাংলাদেশ এবং গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর, মেডিকেল যন্ত্রপাতি- এই তিনটি পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেয়।
Business Initiative Leading Development (BUILD)-এর একটি হিসাব অনুযায়ী, এই চারটি পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক ছাড়ে বাংলাদেশের রাজস্ব ক্ষতি হবে ০.৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবুও বাংলাদেশ তুলনামূলক বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় (যার দাম ১৩২৪ ডলার/মেট্রিক টন) যা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানি করলে কম খরচ হতো।
বাংলাদেশ মার্কিন রপ্তানির বাধাগুলো দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন: টেস্টিং, লেবেলিং, প্যাকেজিং, প্রশংসাপত্র সহজীকরণ, কাস্টমস প্রক্রিয়া সরলীকরণ ইত্যাদি। বাংলাদেশ যখন এসব চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছে, এই সময়ই দ্বিতীয় দফার নতুন শুল্ক ঘোষণা এবং অতিরিক্ত শর্ত আরোপ বাংলাদেশকে একটি জটিল অবস্থায় ফেলেছে। আগামী ১ আগস্টের মধ্যে এগুলো বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশ কিছু নতুন নীতি প্রণনয় করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছা দেখিয়েছে এবং সাধ্যমতো নতুন শর্ত নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ জানিয়েছে, United States Trade Representative (USTR) ঘোষিত যাবতীয় শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করতে তারা প্রস্তুত যদি তা মার্কিন মার্কেটকে স্থিতিশীল রাখতে উপযুক্ত হয়; কিন্তু ১ আগস্ট থেকে যদি ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হয় তাহলে তা বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য একটি বড় ধাক্কা হবে।
৭ মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে ১ নম্বর বাজার আর বাংলাদেশ মাত্র ৫২তম। ফলে এদের মধ্যে তুলনা চলে না। ট্রাম্প বলেন, এই শুল্ক বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য নীতির ফসল। বাংলাদেশ এখনো একটি সীমিত উন্নত দেশ, তাই এমন তুলনা অযৌক্তিক।
শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলো শুরু থেকেই পণ্য বাণিজ্যকে গুরুত্ব দিয়েছে অথচ সেবা রপ্তানি, যেটিতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ, সেটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই খাতে ০ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন আমদানির বিপরীতে মাত্র ১ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেবা খাতে বাণিজ্য ঘাটতি মাত্র ০ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে বেসরকারি খাতের ভূমিকা শুরুতে ছিল না, পাকিস্তানের মতো প্রথম থেকেই বেসরকারি খাতে একজন অভিজ্ঞ লবিস্ট নিয়োগ দেয়া উচিত ছিল। কারণ শুরুর দিকেই বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার প্রক্রিয়ায় শুরুতেই বিজিএমইএ-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যদিও তখন তাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। বিজিএমইএ এমন একটি শুল্ক কাঠামো চায় যা পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছাকাছি থাকে, যাতে দেশের জন্য একটি সর্বজনীন প্রতিযোগিতার পরিবেশ বজায় থাকে।
এছাড়াও NDA (Non-Disclosure Agreement)-এর মধ্যে ভূরাজনৈতিক দিকও থাকতে পারে। এই শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে, ছাঁটাই হবে, মূল্য প্রতিযোগিতা বাড়বে, FDI কমবে এবং সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হবে। বিশেষজ্ঞরা এরকমই কিছু আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশের ৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ১০ লক্ষাধিক মানুষ বেকার হতে পারে। WTO সদস্য হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা শুল্ক WTO নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও, মার্কিন অভ্যন্তরীণ আইন সব আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে বলে মনে হচ্ছে।
প্রেস রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন দাবি করছে; কিন্তু বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনো বিষয়টি জানে না এবং তারা আশাবাদী যে বাংলাদেশ শূন্য শুল্ক সুবিধা পাবে। তারা ধরে নিয়েছে আলোচনা আস্তে আস্তে সেদিকেই এগোচ্ছে।
তৃতীয় দফার আলোচনা শিগগিরই শুরু হবে এবং এবার বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা হচ্ছে। ১ আগস্টের সময়সীমা খুব কাছাকাছি এবং নতুন অনেক বিষয় সামনে আসতে পারে। আমরা চাই, একটি অত্যুত্তম সরকারি-বেসরকারি সমঝোতা, যাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের জন্য একটি ইতিবাচক সমাধান পাওয়া যায়। আমাদের আশাবাদী থাকা উচিত।
ফেরদৌস আরা বেগম: অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে