ইমিটেশন জুয়েলারির বাজার যে কারণে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে
স্বর্ণ নির্মিত অলঙ্কার হচ্ছে বিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত এবং চাহিদাসম্পন্ন অলঙ্কার। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে স্বর্ণালঙ্কারের চাহিদা নেই। বিশেষ করে নারীরা স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি বরাবরই দুর্বল। স্বর্ণালঙ্কার শুধু নারীদের সৌন্দর্য বর্ধন করে তাই নয়, মূল্যবান সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত হয়; কিন্তু স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহারকারীদের এখন সঙ্কটকাল চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে স্বর্ণালঙ্কারের মূল্য সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে স্বর্ণের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখন অনেকেই স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার করতে পারছেন না। স্বর্ণালঙ্কারের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও সৌন্দর্য পিয়াসীদের রূপচর্চা তো আর থেমে থাকছে না। তাই তারা স্বর্ণালঙ্কারের বিকল্প হিসেবে ইমিটেশন জুয়েলারির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে।
রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ বাজারেই ইমিটেশন জুয়েলারি বিক্রি হতে দেখা যায়। মনোলোভা ডিজাইন এবং তুলনামূলক স্বল্প মূল্যের কারণে ইমিটেশন জুয়েলারির চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ইমিটেশন জুয়েলারির ব্যাপক চাহিদা প্রত্যক্ষ করা যায়। নারীরা প্রচুর পরিমাণে ইমিটেশন জুয়েলারি ব্যবহার করছেন। রাজধানীর বাজারে ইমিটেশন জুয়েলারিগুলো কোত্থেকে আসে সে খবর আমরা কজন রাখি? অনেকেই শুনে অবাক হবেন যে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটসহ দেশের আনাচে-কানাচে বাহারি রং ও ডিজাইনের দৃষ্টিনন্দন যেসব ইমিটেশন জুয়েলারি পাওয়া যায় তা আসছে মূলত রাজধানীর প্রান্তঃসীমায় অবস্থিত ভাকুর্তা গ্রাম থেকে। ভাকুর্তা গ্রামে ইমিটেশন জুয়েলারির বিশাল মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। সেখানে অনেকেই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ভাকুর্তা গ্রামের শিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি ইমিটেশন জুয়েলারি দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এগুলো আমাদের দেশের অশিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিত শিল্পীদের হাতে তৈরি। ভাকুর্তার শিল্পীরা যে ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি করে তা আন্তর্জাতিকমানের।
ভাকুর্তা গ্রামের শিল্পীদের হাতে তৈরি ইমিটেশন জুয়েলারির কথা অনেক আগেই শুনেছিলাম; কিন্তু যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি। অবশেষে গত ২৩ জুন সকালে আমি, প্রফেসর মো. জহিরুল হক ভূইয়া এবং সাহিত্যিক কাজী এনায়েত হোসেন ভাকুর্তা গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল পেরিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুদূর যাবার পর ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে একটি পাকা সরু রোড দক্ষিণ দিকে চলে গেছে সেই রাস্তা ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হলো। আনুমানিক ৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর আমরা ভাকুর্তা বাজারে উপস্থিত হই। সেখান থেকে খোঁজ নিয়ে আমরা প্রথমেই তন্বি জুয়েলার্সের মালিক, তরুণ উদ্যোক্তা দুলাল রাজবংশীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হই।
দুলাল রাজবংশী হচ্ছেন ভাকুর্তা ইমিটেশন জুয়েলারি সমবায় সমিতির সভাপতি। দুলাল রাজবংশী ফ্যাক্টরি তার বাড়িতেই অবস্থিত। তিনি আমাদের পেয়ে বেশ আনন্দিত হলেন। আন্তরিকতার সঙ্গে তার কারখানায় উৎপাদিত ইমিটেশন জুয়েলারি দেখালেন। তার কারখানায় তৈরি ইমিটেশন জুয়েলারি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। নিপুণ হাতে তৈরি এসব ইমিটেশন জুয়েলারি যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। দুলাল রাজবংশী জানান, ভাকুর্তা ইমিটেশন জুয়েলারি সমবায় সমিতির সদস্য এবং সদস্য বহির্ভূত মিলিয়ে মোট ২৫০টি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি হয়। এখানকার ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পীরা অত্যন্ত দক্ষ এবং তারা বংশপরম্পরায় এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ভাকুর্তা বাজারে ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পের স্থানীয়করণ হয়েছে। এখানে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি হচ্ছে।
মূলত ২০০০ সাল থেকে ভাকুর্তায় ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিকে সামান্য কয়েকজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি কাজ শুরু করেন। লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় পরবর্তীতে অনেকেই ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এসএমই ফাউন্ডেশন ভাকুর্তার ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পকে ক্লাস্টার শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সন্নিহিত এলাকায় একই নেচারের ৫০ অথবা তারও বেশি শিল্পকারখানা থাকলে তাকে ক্লাস্টার শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দুলাল রাজবংশীর ইমিটেশন জুয়েলারি কারখানা পরিদর্শন করার পর আমরা ভাকুর্তা বাজারে গমন করি। সেখানে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করি এবং তাদের হাতে তৈরি ইমিটেশন জুয়েলারি সম্ভার প্রত্যক্ষ করি।
একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা জানান, আমাদের এখানে যে ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি হয় তা অত্যন্ত উন্নতমানের এবং দাম মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে; কিন্তু যারা ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি কাজে নিযুক্ত তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ফলে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে তারা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এই সুযোগ মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা বাড়ছে। একটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা ক্ষুদ্র শিল্প মালিকদের নিকট থেকে তুলনামূলক কম মূল্যে ইমিটেশন জুয়েলারি কিনে নেন। পরবর্তীতে তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তা উচ্চ মূল্যে বিক্রি করেন। শিল্প মালিকরা যদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতেন এবং উৎপাদিত ইমিটেশন জুয়েলারি সরাসরি বাজারজাত করতে পারতেন তাহলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই লাভবান হতেন।
অনেকেই আছেন যারা বাড়িতে বসে ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি করেন। তারা নিজেরা সরাসরি ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি করেন। আবার কোনো কোনো সময় বিভিন্ন কারখানা থেকে অর্ডার নিয়ে ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি করে কারখানায় সরবরাহ করেন। ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পে যারা কাজ করছেন তাদের ৪০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক। নারীরা ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরিতে বেশ দক্ষ। তাদের হাতের কাজ প্রশংসনীয়। ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তামা এবং পিতল। পুরান ঢাকা থেকে তারা এই উপকরণ সংগ্রহ করে থাকেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ইমিটেশন জুয়েলারি শ্রমিকদের প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দিলেই চলে। শ্রমিকদের একজন জানালেন, তাদের প্রতিদিন কাজের জন্য যে মজুরি প্রদান করা হয় তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এই সামান্য টাকা দিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না; কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বলে তারা বাধ্য হয়ে স্বল্পতম মজুরিতেই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভাকুর্তায় উৎপাদিত ইমিটেশন জুয়েলারি বাইরের দেশগুলোতে রপ্তানির সুযোগ আছে বলে জানালের দুলাল রাজবংশী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব বাংলাদেশি বাস করেন তাদের অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কিছু ইমিটেশন জুয়েলারি নিয়ে যান। তারা সেগুলো বিক্রি করেন। তবে বৃহৎ পরিসরে এখনো ইমিটেশন জুয়েলারি রপ্তানি শুরু হয়নি। ইমিটেশন জুয়েলারি রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয় তা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই স্বল্প শিক্ষিত এবং রপ্তানির আইনকানুন সম্পর্কে অবহিত নন। তিনি আরও জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ভারত-চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশে গিয়েছেন। এসব দেশে বাংলাদেশি ইমিটেশন জুয়েলারির বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব। তিনি কিছু ইমিটেশন জুয়েলারি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। এগুলো দেখে বিদেশি ক্রেতারা বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের এই আগ্রহ কাজে লাগানো গেলে এসব দেশে ইমিটেশন জুয়েলারি রপ্তানি করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারির পরিকল্পিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
ভাকুর্তার ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পের উদ্যোক্তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পুঁজির স্বল্পতা। এখানে যারা ক্ষুদ্র পরিসরে ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি করছেন তাদের আর্থিক অবস্থা মোটও ভালো নয়। তাই চাইলেই তারা কারখানার পরিসর বাড়াতে পারছেন না। ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পে এখনো ব্যাংক থেকে প্রচলিত ধারায় ঋণ প্রদান করা হয় না। ঋণ পাওয়ার জন্য জামানত দিতে হয়; কিন্তু অধিকাংশ শিল্প উদ্যোক্তার জামানত প্রদানের সক্ষমতা নেই। দুলাল রাজবংশী জানান, ব্যাংক থেকে যদি তুলনামূলক স্বল্প সুদে এবং সহজ শর্তে ঋণদান করা হতো তাহলে ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে পারত। বর্তমানে ইমিটেশন জুয়েলারির চাহিদা কিছুটা কম; কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে ইমিটেশন জুয়েলারির ব্যাপক চাহিদা লক্ষ করা যায়। সরকারি পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছেন।
নতুন প্রজন্ম ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চান না। কোনো কোনো উদ্যোক্তা ইমিটেশন জুয়েলারি তৈরি পেশা থেকে নিজেদের সরিয়ে অন্য কোনো পেশায় নিয়ে যাচ্ছেন। এসএমই ফাউন্ডেশনের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানালেন, ভাকুর্তা ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পকে ক্লাস্টার শিল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামীতে এই শিল্পের জন্য তুলনামূলক সহজ শর্তে এবং কম সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
এই শিল্পের জন্য সহজ শর্তে তুলনামূলক কম সুদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে এই শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হতে পারে। ভাকুর্তার ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্প মালিকরা দাবি করেন, তারা যে পণ্য তৈরি করেন তা অত্যন্ত উন্নতমানের এবং দৃষ্টিনন্দন। তবে কর্মরত শ্রমিকদের যদি প্রশিক্ষণ দেয়া যেত তাহলে কাজের গুণগতমান আরও উন্নত হতে পারত।
ভাকুর্তা বাজারের বিভিন্ন কারখানার প্রদর্শনী সেন্টারের শোকেসে সাজানো ইমিটেশন জুয়েলারি যে কোনো সৌন্দর্য পিয়াসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সৌন্দর্য পিয়াসী যে কেউ ইচ্ছে করলে ভাকুর্তা বাজারে গিয়ে ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্প দেখে আসতে পারেন। আশা করি এই ভ্রমণ সার্থক হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাকুর্তার ইমিটেশন জুয়েলারি শিল্পের উন্নয়নে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন- এই প্রত্যাশা রইল।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে