বাড়তি দামের ফাঁদে পুঁজিই হারাতে বসেছেন রাজারহাটের ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীরা!
সিন্ডিকেটের কবলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাট। চামড়ার বাড়তি মূল্য নির্ধারণের ফাঁদে পড়ে পুঁজিই হারাতে বসেছেন ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, সরকারের মূল্য নির্ধারণে মাঠ পর্যায়ে বাড়তি দামে চামড়া কিনেছেন তারা; কিন্তু বাড়তি মূল্য দিচ্ছেন না পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। এতে পুঁজিই হারানোর দশা তাদের।
আড়তদারদের বেধে দেয়া দামে হতাশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া প্রতি পিস চারশ’ থেকে ছয়শ’ এবং বড় চামড়া সর্বোচ্চ আটশ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ছাগলের চামড়ার দাম প্রতিটি ২০ থেকে ৩০ টাকা। অথচ এর কমপক্ষে দেড়গুণ ব্যয় করে মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া হাটে নিয়ে এসেছেন তারা।
অন্যদিকে আড়তদারদের সাফ কথা, ‘দাম নির্ধারণ করে দিলেও সরকার তো চামড়া কেনে না। ট্যানারি মালিকরা যেভাবে দাম দেবেন, সেভাবেই বেচা-কেনা করতে হবে।’
মঙ্গলবার (১০ জুন) কোরবানির ঈদ-পরবর্তী প্রথম হাট ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় পরিবহনে চামড়া এনে স্তূপ করে রেখেছেন ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সেগুলো উল্টে-পাল্টে দেখছেন স্থানীয় আড়তদাররা। দাম নিয়ে চলছে দুপক্ষের দর কষাকষি।
আড়তদাররা বলছেন, এখানকার বড় হাট শনিবার হওয়ায় এখন মূলত বাজার যাচাইয়ে ব্যস্ত সবাই। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কম দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। মূলত ট্যানারি মালিক-আড়তদারদের সিন্ডিকেট দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে তারা পুঁজি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
ঢাকার পরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার মোকাম রাজারহাটে রয়েছে তিন শতাধিক আড়ত। সপ্তাহে দুদিন শনি ও মঙ্গলবার হাটটিতে এসে চামড়া বেচা-কেনা করেন খুলনা বিভাগের দশ জেলা ছাড়াও ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর এবং ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এই হাট ঘিরে জীবন-জীবিকা চলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ হাজার ছোট-বড় ব্যবসায়ী পরিবারের।
কোরবানির ঈদ ঘিরে বছরের এই সময়টাতে কয়েকটি হাটবারে রাজারহাটে প্রায় শত কোটি টাকার চামড়া বেচা-কেনা হয়ে থাকে। তবে, আড়তদাররা জানান, কোরবানির গরু-ছাগলের চামড়ার আমদানি এবার অন্যবারের তুলনায় বেশ কম।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কোলা দীঘলিয়া গ্রাম থেকে ১০০ পিস গরুর চামড়া নিয়ে হাটে এসেছিলেন অলোক বিশ্বাস।
তিনি জানান, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ, লবণ লাগানো এবং পরিবহন মিলিয়ে প্রতি পিস চামড়ার খরচ পড়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে শ্রমিক-পথ খরচও। সেই চামড়ার দাম ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকার বেশি উঠছেই না। বাধ্য হয়ে ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রতিটি চামড়ায় গড়ে ২০০ টাকা করে লোকসান।
অলোক বিশ্বাস জানান, দাম বাড়িয়ে সরকারের মূল্য নির্ধারণের ঘোষণায় মাঝারি আকারের চামড়াও ৫০০-৬০০ টাকার নিচে বিক্রি করতে রাজি হননি গৃহস্থরা। সরকারি দামে চামড়া কিনে এখন তাদের পথে বসার উপক্রম।
রাজারহাটে চামড়া কিনতে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী এস এম শামীম সাতশ’ থেকে ১ হাজার টাকা দামে ২ হাজার পিস চামড়া কিনেছেন। তিনি জানান, ট্যানারি মালিকরা যে দাম দেবেন, সেই হিসাব করেই চামড়া কিনতে হচ্ছে। কারণ, চামড়া তো ট্যানারিতেই বিক্রি করতে হবে। ফলে সরকার নির্ধারিত বাড়তি দামে কিনলে লোকসানের শঙ্কা আছে।
৫০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে ৩০০ পিস চামড়া কিনেছেন রাজারহাটের আড়তদার হাসিব চৌধুরী। তার দাবি, সরকার তো আর চামড়া কেনে না, কেনেন ট্যানারি মালিকরা। সরকার তাদের সঙ্গে কথা বলে দাম নির্ধারণ করেছে বলেও মনে হচ্ছে না। ট্যানারি মালিকরা যে দাম দিচ্ছেন, হাটেও সেই দামে বিক্রি হচ্ছে।
তবে দুপক্ষই মনে করছেন, শনিবার (১৪ জুন) সাপ্তাহিক বড় হাট বসবে। সেদিন অনেক বড় ও পাইকারি ব্যবসায়ী এবং ট্যানারির প্রতিনিধিরা চামড়া কিনতে হাটে আসবেন। সেদিন বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে।
বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহসভাপতি সাঈদ আহমেদ নাসির শেফার্ড বলেন, মঙ্গলবার প্রথম ও ছোট হাট হওয়ায় ছয় হাজারের মতো গরুর চামড়া উঠেছিল। বাজারও ছিল বেশ নিম্নমুখী। বেশিরভাগই চামড়াই ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। মূলত সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে বাজারের সামঞ্জস্য নেই বলেই এই পরিস্থিতি।
শেফার্ড বলেন, শনিবারের হাটের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই। সেদিন প্রচুর চামড়া আমদানির পাশাপাশি ঢাকাসহ সারা দেশের বড় ব্যবসায়ী-আড়তদাররা আসবেন। আবার ট্যানারির লোকজনও আসবেন। কেনা-বেচার প্রতিযোগিতা বাড়লে দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে