খেলায় রাজনীতি, রাজনীতির খেলা
নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৫ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সফর স্থগিত করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। কাছাকাছি সময়ে ঢাকা সফরে আসার কথা ছিল দেশটির ফুটবল দলের। ক্রিকেটের মতো বাংলাদেশ সফরে না আসতে সকারুরাও বেঁকে বসে। তাদের দাবি ছিল- ম্যাচ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক। বিশ্ব ফুটবল সংস্থা (ফিফা) এবং এশিয়ান ফুটবল সংস্থা (এএফসি) বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার পর ঘোষণা দেয়- ম্যাচ ঢাকাতেই হবে। তোমরা খেলতে অস্বীকৃতি জানালে বাংলাদেশ তিন পয়েন্ট পাবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) কিন্তু অজিদের বাংলাদেশ সফরে বাধ্য করতে পারেনি।
ফিফার কঠোর অবস্থানের কারণে চাটার্ড বিমানে করে ২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকায় এসে ম্যাচ খেলতে বাধ্য হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কেবল ফুটবল নয়, অধিকাংশ ক্রীড়া ডিসিপ্লিনের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বেশ কঠোর। আইসিসি আদৌ তেমন ভূমিকা নিতে পারে কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। অতীতের নানা ঘটনায় সে প্রশ্ন প্রকট হয়েছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ঘটনাচক্রে আইসিসির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে।
অন্যান্য খেলার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে আইসিসির বিসদৃশ্যতা আছে এমন হাজারটা! ফুটবলের সূক্ষ্ম ও কঠোর নীতিমালার বিপরীতে আইসিসিকে নতজানু হতে দেখা যায় হরহামেশা। উপমহাদেশের জনপ্রিয় এ খেলায় একটা সময় ছড়ি ঘোরাত ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, এখন একচ্ছত্র আধিপত্য ভারতের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত ট্রল হচ্ছে যে, ‘বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) আইসিসিকে খুব একটা পাত্তা দেয় না।’ সেখানে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) আবার কোন হেডমওয়ালা! এ কারণেই দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হাজির দর্শকরা এক টিকিটে দুই শো দেখলেন!
১৪ সেপ্টেম্বর শুরুটা করেছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব- পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আলী আগার সঙ্গে হাত না মিলিয়ে। যা দুই দেশের বৈরী সম্পর্কের আগুনে যা ঘি ঢেলেছে। শেষটা ছিল পাকিস্তানি মহসিন নাকভির হাত থেকে এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ান ট্রফি নিতে ভারতীয় দলের অস্বীকৃতি জানানোর মাধ্যমে। মহসিন নাকভি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) প্রধান এবং দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ান দলকে ট্রফি তুলে দেওয়ার বিধান এসিসি প্রেসিডেন্টের। সে হিসেবে মহসিন নাকভি মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন; কিন্তু ভারতীয় দলের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়- মহসিন নাকভির হাত থেকে আমরা ট্রফি নিচ্ছি না। বিকল্প হিসেবে এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান খালিদ আল জারুনির নাম প্রস্তাব করে ভারতীয় দল। জানানো হয়, তার হাত থেকেই ট্রফি নিতে চাই আমরা।
বলার অবকাশ রাখে না- দুই প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক বৈরিতার রুগ্ণ প্রদর্শনী হয়ে গেল শারজাহ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। পাকিস্তানের অধিনায়কের সঙ্গে হাত না মেলানোর প্রসঙ্গ খোলাসা করতে সূর্যকুমার যাদব বলেছিলেন, ‘ভারত সরকার ও বিসিসিআইর অবস্থানের সঙ্গে সংগতি রেখেই আমার দল এমন আচরণ করেছে।’ অতীতে দুই প্রবল বৈরী দেশের রাজনীতির টানাপোড়েনও খালি চোখে বোঝা কঠিন ছিল। এশিয়া কাপে এসে সেটা কোনো রাখঢাক রাখল না! এখন খালি চোখেই সবকিছু দেখা যাচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিরিজ স্থগিত হয়ে আছে। মুম্বাই হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ বাতিল করেছিল। তারপর থেকে দুই দেশের লড়াই কেবল আইসিসির ইভেন্টেই দেখা যেত। রাজনীতির জাঁতাকলে সেটাও কি বন্ধ হয়ে যাবে?
এশিয়া কাপে দুই দেশের মধ্যকার তিক্ততা মাঠ ছাপিয়ে গড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ম্যাচ শেষ হওয়ার খানিক বাদে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘খেলার মাঠেও অপারেশন সিঁদুর। ফলাফল একই- ভারতের জয়।’ দ্রুত জবাব দিয়েছেন মহসিন নাকভি। তার রিটুইট ছিল এমন, ‘যদি যুদ্ধই আপনার গর্বের মাপকাঠি হয়, ইতিহাস এরই মধ্যে পাকিস্তানের হাতে আপনার লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা লিখে রেখেছে। কোনো ক্রিকেট ম্যাচ সেই সত্যকে বদলাতে পারবে না। খেলায় যুদ্ধ টেনে আনা শুধু হতাশাকে প্রকাশ করে আর খেলার মূল চেতনাকেই কলঙ্কিত করে।’
বাইরের ঘটনা মাঠে প্রভাব ফেলার এমন নজির অবশ্য নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন খেলায়, বিভিন্ন দেশে এমনটা দেখা গেছে। ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চিলিতে গিয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে চিলিকে বিজয়ী ঘোষণার মাধ্যমে ওই ঘটনায় লাগাম টেনেছিল ফিফা। বার্সেলোনার ফুটবল ম্যাচে দর্শকদের হাতে কাতালান স্বাধীনতা আন্দোলন-সংক্রান্ত ব্যানার প্রায়ই দেখা যায়। লা লিগা ও দেশটির ফুটবল কর্তৃপক্ষ অবশ্য সূক্ষ্মভাবেই বিষয়গুলো দেখভাল করে। ভারত-পাকিস্তানের তিক্ততার ক্ষেত্রে আইসিসি কি তেমন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে?
রাজনীতি যে কেবল মাঠের খেলায় বিষ ছড়িয়েছে- বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। বরং রাজনৈতিক বৈরিতার পরও খেলাধুলার মাধ্যমে ফুলের সুরভিও ছড়িয়েছে। ১৯৯৮ সালের ২১ জুন ফ্রান্সের লিঁও শহরে বিশ্বকাপ ম্যাচ শুরুর আগে ইরান দলের খেলোয়াড়রা যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের হাতে সাদা গোলাপ তুলে দেন। যা ছিল শান্তি ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। দুই দলের সদস্যরা একসঙ্গে ছবি তোলেন, যা ছিল রাজনৈতিক উত্তেজনার বিপরীতে এক মানবিক বার্তা। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই কূটনৈতিক উত্তেজনা চলছে। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব ও তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখলের পর থেকে সেটা চলে আসছে। তারপরও ফুটবলে বৈরী দুই দেশ সৌহার্দ্যের বার্তা দিয়ে গেছে। ম্যাচটিকে অনেকে বলেছিলেন ‘দ্য মাদার অব অল ম্যাচেস’। কারণ, দুই শত্রু দেশের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে অনেকের মাঝে ছিল ভিন্ন ধরনের কৌতূহল। ইরান ২-১ গোলে যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়েছিল ওই ম্যাচে। যাকে ফিফা ও জাতিসংঘ ‘স্পোর্টস ফর পিস’ আন্দোলনের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছিল।
যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে আবার ভিন্ন চিত্রও দেখেছে ক্রীড়া বিশ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের ওপর আগ্রাসন চালানোর কারণে ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক বয়কট করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রভাবে আরও ৬৫ দেশ মস্কো অলিম্পিকে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। ফলে গেমসের আকৃতি ছোট হয়ে আসে। ১৯৫৬ সালের পর ওটাই ছিল সবচেয়ে ছোট অলিম্পিক গেমস; যেখানে ৮০ দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৫৬ সালের আসর ‘মেলবোর্ন গেমস’ নামেই পরিচিত, যদিও ঘোড়দৌড়ের তিন ইভেন্ট হয়েছিল সুইডেনের স্টকহোমে। সে আসরে অংশ নিয়েছিল ৭২ দেশ।
রাজনৈতিক প্রভাব কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে রক্তও ঝরিয়েছে! ১৯৫৬ সালের অলিম্পিক গেমসের অন্যতম আলোচিত ছিল হাঙ্গেরি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ওয়াটার পলো ম্যাচ। সোভিয়েত ইউনিয়ন সদ্যই হাঙ্গেরিতে গণবিদ্রোহ দমন করেছিল। যার ফলে ম্যাচের আগেই উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। ম্যাচ চলাকালীন দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বাঁধে হট্টগোল, ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। হাঙ্গেরির আরভিন জ্যাডর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্যালেন্তিন প্রোকোপভের ঘুষিতে রক্তাক্ত হন। দর্শকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল সহিংসতা। পুলিশ দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল বলে রক্ষা।
১৯৮০ সালের মস্কো গেমস বয়কট করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, আর তার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস গেমস বয়কট করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কয়েকটি দেশও সোভিয়েতের পথে হেঁটে গেমসে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। রাজনৈতিক এই খেলার মাঝেও যে ক্রীড়া আসর সফল করা যায়- তা দারুণভাবে করে দেখিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৪০ দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আসরটি রেকর্ডবুকে স্থান করে নিয়েছিল। আধুনিক অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে আর্থিকভাবে সফল গেমস হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ওই আসর। ১৯৮৪ সালের অলিম্পিক গেমস ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি লাভ করেছিল।
রাজনৈতিক বৈরিতার বারুদ ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ‘হ্যান্ড অব গড’-এর জন্ম দিয়েছিল। ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে দিয়েগো ম্যারাডোনা তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘আমরা শুধু একটি ফুটবল দলকে নয়, একটি দেশকে পরাজিত করেছি। যদিও ম্যাচের আগে আমরা বলেছিলাম যে ফুটবলের সঙ্গে মালভিনাস যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা জানতাম তারা অনেক আর্জেন্টাইন শিশুকে হত্যা করেছে- মনে হয়েছিল যেন ছোট পাখির মতো মেরে ফেলেছে। আর এই জয় ছিল তার প্রতিশোধ।’ প্রতিশোধ, প্রতিরোধ ছাপিয়ে খেলাটা হোক বন্ধুত্বের, সৌহার্দ্যের!
মাহবুব সরকার: লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে