মানুষ পুকুর-খালকে অতীত নয়, ভবিষ্যতের অংশ হিসেবে দেখুক
একসময় ঢাকা ছিল খাল, পুকুর ও নদীর শহর। আজ সেই জলজ নেটওয়ার্ক হারিয়ে যাচ্ছে দখল ও উন্নয়নের চাপে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঢাকার সেই রূপ হয়তো এখন গল্পের মতো শোনায়, কারণ অধিকাংশ খাল ও পুকুর আজ বিলীন। নগরজীবন, পরিবেশ ও নাগরিক সংকট নিয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে কাজ করছেন সাংবাদিক ও লেখক হেলিমুল আলম। সম্প্রতি প্রকাশিত তার দুটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ- ‘‘Oasis Lost to Urban Sprawl: An In-Depth Look into Dhaka’s Lost Ponds’’ এবং ‘‘Dhaka’s Canals on Their Dying Breath, An In-Depth Look at How the Capital's Waterways Are Being Choked’’ নগর ইতিহাস ও পরিবেশ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে পাঠকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সম্প্রতি ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষে ‘নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম-বাংলাদেশ’ (ইউডিজেএফবি)-এর সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল খান তার সাংবাদিকতা, মাঠ গবেষণা, শৈশবের স্মৃতি এবং জলাশয় রক্ষার প্রতিশ্রুতি বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার নেন।
ফয়সাল খান: পুকুর-খালকে বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ কী?
হেলিমুল আলম: পুকুর ও খাল আমাদের জীবনের অমূল্য সম্পদ। আমি বড় হয়েছি ঢাকার মিরপুরে; ছোটবেলায় চারটি বড় পুকুরে সাঁতার কেটেছি, বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছি। আজ সেগুলোর জায়গায় মার্কেট ও কংক্রিট। এই ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং মাঠ-গবেষণাই আমাকে বিষয়টির দিকে টেনেছে। ঢাকার জলাবদ্ধতা ও বন্যার অন্যতম কারণ হলো প্রাকৃতিক জলাধারগুলোর হারিয়ে যাওয়া। তাই এগুলো নথিভুক্ত করা শুধু পরিবেশ নয়, আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস রক্ষারও কাজ।
ফয়সাল খান: আপনার দুটি বই সম্পর্কে বলেন?
হেলিমুল আলম: ঢাকার পুকুর নিয়ে লেখা বইটি মূলত শহরের হারিয়ে যাওয়া জলাধারগুলোর একটি বিস্তৃত দলিল। ২০১৭ সালে The Daily Star পত্রিকায় প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এটি রচিত। তখন সিটি করপোরেশনের মানচিত্র ধরে অন্তত ১০০টি পুকুর ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে আরও গবেষণা যোগ করে ২০২৩ সালে বইটি প্রকাশ করি।
‘Dhaka’s Canals on Their Dying Breath’ বইটি ঢাকার খালসমূহ নিয়ে গবেষণাভিত্তিক কাজ। এতে রয়েছে মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং ২০১৬ ও ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ। একসময় যেসব খাল নৌকা ও মানুষের চলাচলে মুখর ছিল, আজ সেগুলো অনেকখানি নর্দমায় পরিণত। বইটিতে অতীত, বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ- সব দিক তুলে ধরেছি। আমার বিশ্বাস, নাগরিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এখনো অনেক খাল ও পুকুর পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।
ফয়সাল খান: সাংবাদিকতায় আসার গল্পটা কেমন ছিল?
হেলিমুল আলম: খুব পরিকল্পনা করে সাংবাদিকতায় আসিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময়ই এ পেশা আমার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে শুরু, আর ২০০১ সালে দ্য নিউ নেশন পত্রিকায় যোগ দিয়ে ইংরেজি সংবাদ জগতে প্রবেশ করি। পরে The New Age পত্রিকায় কাজ করেছি, বর্তমানে The Daily Star পত্রিকায় কর্মরত আছি। সাংবাদিকতা আমাকে শিখিয়েছে- একটি সংবাদ শুধু তথ্য নয়; এটি মানুষের সচেতনতা তৈরি করে এবং নীতিনির্ধারকদের নড়েচড়ে বসায়। এই বিশ্বাসই আমাকে এখনো ধরে রেখেছে।
ফয়সাল খান: সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কীভাবে বই লেখায় সাহায্য করেছে?
হেলিমুল আলম: সাংবাদিকতা আমাকে কলা, অনুসন্ধানের কৌশল ও তথ্য যাচাইয়ের ধৈর্য শিখিয়েছে। সংবাদে গতি থাকে, কিন্তু বই লেখায় গভীরতা- এই দুই অভিজ্ঞতার সমন্বয়েই গবেষণাগুলো প্রাণ পেয়েছে। মাঠভিত্তিক রিপোর্টিং ছিল বইগুলোকে বাস্তবমুখী করার মূল উপাদান।
ফয়সাল খান: ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন কী?
হেলিমুল আলম: আমার কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো মানুষের ভালোবাসা। একবার একটি হাউজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করেছিলাম, যারা কয়েকটি পরিবারের চলাচলের পথ দেয়াল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিনই কোম্পানিটি দেয়াল ভেঙে দেয়। পরে এলাকার মানুষ আমাকে লিখিত ধন্যবাদ জানান- সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, সাংবাদিকতার সার্থকতা পেয়েছি।
অবশ্য, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিগুলোও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এ পর্যন্ত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (DRU) থেকে চারবার বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, চারটি পৃথক সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য- এর মধ্যে একটি ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক। এ ছাড়া ওয়াটার রিপোর্টার্স ফোরাম বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামাজিক সংগঠন টাচিং সোলস ইন্টারন্যাশনাল-এর পক্ষ থেকেও একটি ফেলোশিপ পেয়েছি।
তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন হলো DRU সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩। আমার প্রথম বইয়ের জন্য গবেষণা বিভাগে এই পুরস্কারটি পেয়ে আমি লেখক হিসেবে নিজের অস্তিত্বের স্বীকৃতি অনুভব করেছি। এটি আমার জীবনের এক বিশেষ মাইলফলক।
ফয়সাল খান: সাংবাদিকতার পরিবর্তন আপনি কীভাবে দেখছেন?
হেলিমুল আলম: যখন শুরু করি, সাংবাদিকতা ছিল মানুষের কথা বলার এক সরল মাধ্যম। এখন প্রযুক্তি তথ্যপ্রবাহকে দ্রুততর করেছে, তবে মূল নীতি অপরিবর্তিত- সত্য অনুসন্ধান। চ্যালেঞ্জ হলো, তথ্যের ভিড়ে নির্ভরযোগ্যতা রক্ষা করা। এজন্য মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান ও বাস্তবতার যাচাই আগের চেয়ে আরও জরুরি।
ফয়সাল খান: আপনার লেখায় ‘শহর’ কেন বারবার ফিরে আসে?
হেলিমুল আলম: শহর কেবল বসবাসের জায়গা নয়, এটি এক জীবন্ত সত্তা। ঢাকাকে আমি দেখি ক্লান্ত, তবু প্রাণবন্ত একটি শহর হিসেবে। এর জল, গাছ, খাল ও মানুষ মিলেই শহরটি টিকে আছে। সাংবাদিকতা আমার কাছে এই শহরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এক উপায়। ঢাকার আলো, বাতাস, মাঠ ও খাল- সবই আমার বেড়ে ওঠার অংশ। তাই এই শহরের ক্ষয় আমাকে কষ্ট দেয়, আর সেই কারণেই লেখার মাধ্যমে আমি একে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি।
ফয়সাল খান: বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ কী?
হেলিমুল আলম: প্রথমত, অপরিকল্পিত নগরায়ণ। একসময় খাল ছিল ঢাকার প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা। সেগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় আজ জলাবদ্ধতা প্রকট। দ্বিতীয়ত, আমরা সাংস্কৃতিকভাবে জলাশয়ের গুরুত্ব ভুলে গেছি। একসময় পুকুর ছিল আড্ডার স্থান, খাল ছিল চলাচলের পথ। এখন শুধু জমি হিসাবেই দেখি- এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
ফয়সাল খান: তরুণ সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
হেলিমুল আলম: ধৈর্য ধরতে হবে, কৌতূহল ধরে রাখতে হবে। দ্রুত সংবাদ প্রকাশের চাপ বাড়লেও ভালো সাংবাদিকতা আসে গভীরতা থেকে। মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে, ভেতরের সত্য খুঁজে বের করতে হবে। আরেকটি কথা- কোনো বিষয় ছোট নয়। পুকুর-খাল নিয়ে কাজ শুরু করলে অনেকে বলেছিলেন, ‘এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না’। কিন্তু পরে দেখা গেল, এখানেই আমাদের বড় সমস্যার ইঙ্গিত লুকানো। তাই নিজের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ফয়সাল খান: পাঠকের জন্য আপনার বার্তা কী?
হেলিমুল আলম: আমি চাই, মানুষ পুকুর-খালকে অতীত নয়, ভবিষ্যতের অংশ হিসেবে দেখুক। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির সংকট, নগরের জলাবদ্ধতা- এসব সমাধানে প্রাকৃতিক জলাশয় অপরিহার্য। সবচেয়ে বড় কথা, উন্নয়ন মানে শুধু সড়ক-ভবন নয়- টেকসই পরিবেশ আর সংস্কৃতি রক্ষা। আমার লেখার মাধ্যমে যদি এই উপলব্ধি জন্মায়, তবে আমি সফল। “একটি পুকুর বা খাল শুধু পানি নয়- এটি স্মৃতি, সমাজ এবং টিকে থাকার শক্তি। আমরা যদি এগুলো হারাই, তবে নিজেদেরও একটি অংশ হারাব।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে