ব্যাংকিং খাতে সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে দ্বৈতশাসন
বাংলাদেশের অর্থনীতির যে খাতটি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকিং খাতকে একটি দেশের অর্থনীতির ধমনিতে রক্ত প্রবাহের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কোনো মানুষ বা প্রাণির ধমনিতে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিকভাবে চলাচল না করলে যেমন শারীরিক অসুবিধা দেখা দিতে পারে। এমনকি প্রাণির মৃত্যুও হতে পারে। ঠিক তেমনি কোনো দেশের ব্যাংকিং খাত যদি স্বাভাবিক গতিতে সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তাহলে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সমস্যা দেখা দেবেই। আর্থিক সামর্থ্যহীনতার কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের উদ্যোক্তাদের পুঁজির চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাংকের কাছে ধরনা দিতে হয়; কিন্তু ব্যাংকিং খাত উদ্যোক্তা এবং সাধারণ ঋণ গ্রহীতাদের কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা দিতে পারছে না।
বিগত সরকার আমলের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছিল। ব্যাংকিং খাত মূলত সরকার সমর্থক বিশেষ গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। সেই বিশেষ মহল বা গোষ্ঠী যেভাবেই চাইতেন ব্যাংক খাতের বিদ্যমান আইনগুলোকে সেভাবেই পরিবর্তিত/ সংশোধিত করা হতো। আমাদের দেশের ব্যাংকিং আইনগুলো ঋণ খেলাপি এবং দুষ্টু গ্রাহকদের ক্ষেত্রে যতটা উদার নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারীদের প্রতি ততটা উদার নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নানা আইনি মারপ্যাঁচে ঋণেরই কিস্তি আদায় না করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সরকারের এই প্রচেষ্টাকে ‘কার্পেটের নিচে ময়লা রেখে ঘর পরিষ্কার দেখানো’র ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেছিলেন। বিগত সরকার আমলে যারা ব্যাংকিং খাত পরিচালনা করতেন তাদের মধ্যে কিস্তি আদায় না করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর বিপজ্জনক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যেত। সর্বশেষ হিসাব মোতাবেক, দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু ব্যাংক সংশ্লিষ্টগণ মনে করেন খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ আরো অনেক বেশি। ব্যাংকিং খাত যে ভালো নেই এটা যে কোনো ব্যক্তিই স্বীকার করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যাংকিং খাতের এই দুরবস্থার জন্য কে বা কারা দায়ী?
কথায় বলে, দেহের কোনো অঙ্গহানি হলেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে; কিন্তু কারও মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটলে তার পক্ষে কোনোভাবেই স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমরা ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার কারণ খুঁজতে গিয়ে নানা কথা বলি কিন্তু প্রকৃত কারণ অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই খাতে দ্বৈত শাসন চলছে। দ্বৈত শাসন কোনো ভালো ফল দেয় না তা আমরা ইংরেজরা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেউয়ানি লাভের পর আমরা ভালোভাবেই টের পেয়েছি। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবার সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় ঘটলে মীর জাফর বাংলার নবাব নিযুক্ত হন। সেই সময় ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শাহর কাছে থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেউয়ানি লাভ করে। ইংরেজরা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করেন। আর নবাব আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় লাখ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ করে। সেই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বৈতশাসন কখনোই একটি দেশ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। কোনো খাতকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য একক কর্তৃত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অনেক দিন ধরেই দ্বৈতশাসন চলছে। যে কারণে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ভোগ করে থাকে। তারা নিজেদের ইচ্ছে ও বিবেচনা মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। সে সিদ্ধান্ত সরকারের পছন্দ নাও হতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ নেই। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারী হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছুই করার থাকে না। বিগত সরকার আমলে সর্বশেষ ৯টি ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক অনুমোদন দানের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছিল; কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই আপত্তি গ্রাহ্য করেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত (বর্তমানে প্রয়াত) বলেছিলেন, এ মুহূর্তে দেশে নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজন নেই; কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হলো। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগেই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোনো কিছু করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিকেই অনুমোদন দেয় যারা সরকারের একটি বিশেষ মহলের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের আগে যে দুজন গভর্নর ছিলেন (ড. ফজলে কবীর ও আব্দুর রউফ তালুকদার) তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ করেছেন। তারা কোনোভাবেই খ্যাতিমান ব্যাংকার ছিলেন না। যারা দীর্ঘ দিন সরকারি চাকরি করেন তারা সাধারণত স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত থাকেন। যারা সরকারি চাকরি করেন তারা আসলে খাঁচায় বন্দি অনুগত পাখির মতো। মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিলেও তারা স্বাধীনভাবে উড়তে পারে না। তারা আবারও খাঁচায় চলে আসে। সরকারি চাকরিজীবীদের অবস্থায় ঠিক তাই। তারা চাইলেই মন্ত্রী বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। যে ব্যক্তি এক সময় বস ছিলেন তিনি যদি মন্ত্রী হয়ে যান তাহলে কি অধীনস্ত ব্যক্তির পক্ষে তার নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব হবে?
বিগত সময়ে এক সময়ের আমলা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ড. ফজলে কবীর এবং আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংকিং খাতে কি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ব্যবসায়ীদের অনুষ্ঠানে গিয়ে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমানতের সর্বোচ্চ সুদ হার রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় ৬ শতাংশ ঘোষণা দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে উপস্থিতি হয়ে ব্যাংকের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রদানের এই ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। উদ্বৃত্ত অর্থের মালিকরা যাতে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ করেন সেই লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতের ওপর সুদ হার দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়।
পাশাপাশি আগে নিয়ম ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে তাদের আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সংরক্ষণ করতে পারতো। আর অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক এই নিয়ম পরিবর্তন করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৫০ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের স্বার্থ সংরক্ষণ না করে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে। সরকারের বিশেষ আশির্বাদপুষ্ট গোষ্ঠী কিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতো তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপি ঋণ হিসাব পুনর্গঠন করা।
২০১৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় তিন মাস ব্যাপী আন্দোলন করে। সেই সময় সরকারি বাহিনীর ছত্রছায়ায় একটি বিশেষ মহল দেশব্যাপী অগ্নি সন্ত্রাস চালায়। এতে বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়। সালমান এফ রহমান এবং তার মতো আরও কিছু উদ্যোক্তার পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা এবং তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করে। ১১টি উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর ১৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ সহজ শর্তে পুনঃতপশিলীকরণ করিয়ে নেয়া হয়। তখনই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল, রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণ কি শুধু ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের ঋণ খেলাপিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল? যারা ৪৯৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি তারা কি ক্ষতিগ্রস্ত হননি? তাহলে বিশেষ মহলকে শুধু এই সুবিধা দেয়া হলো কেনো? সুবিধাটি কি সবার জন্য অবারিত করা যেত না?
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল তার দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন। তিনি এমন সব আইনি পরিবর্তন করেছেন যা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতটা বিতর্কিত এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর অর্থমন্ত্রী আর একজনও আসেননি। তিনি বিভিন্ন পরিসংখ্যান ম্যানিপুলেট করে সরকারের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল ছিল না। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেননি। আ হ ম মুস্তাফা কামালই ছিলেন একমাত্র ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী এবং তার আমলেই ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে। আগে নিয়ম ছিল কোনো ঋণ হিসাব সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতপশিলীকরণ করা যেত। এ জন্য প্রথম বার পুনঃতপশিলীকরণের জন্য মোট খেলাপি ঋণের ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ব্যাংকে নগদে জমা দিতে হতো। দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। আ হ ম মুস্তাফা কামাল তার মেয়াদ শেষকালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হয়।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছে। তারা স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের ওপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেই নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। তার এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যাংকিং খাতকে সুষ্ঠু ধারায় পরিচালিত করার জন্য এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণায়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে বিলুপ্ত করা যেতে পারে। নব্বইয়ের দশকে এম সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকাকালে একবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কেনো আবারো এই বিভাগকে পুনর্বহাল করা হলো তা বোধগম্য হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা কর্মরত আছেন তাদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা একটি বিশেষ শ্রেণির কর্মকর্তা তাদের ব্যক্তিগত লাভের আশায় বিতর্কিত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন। এদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কিভাবে একটি মহতী পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেন তার একটি প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে ‘কৃষি ও পল্লি ঋণ’ কার্যক্রম। ২০১০ সালে এই কার্যক্রম চালু করা হয়। গ্রামীণ এলাকায় কৃষি ভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোগ গড়ে তোলার জন্য কৃষি ও পল্লি ঋণ কার্যক্রম চালু করা হয়। এই ছিল ব্যতিক্রমধর্মী একটি ঋণদান কার্যক্রম। ব্যাংকগুলোকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ কৃষি ও পল্লি ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে হতো। কোনো ব্যাংক যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হতো তাহলে অব্যবহৃত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের জমা নিয়ে সুদবিহীন আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করা হতো। পরবর্তী বছর সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নতুন কোনো শাখা খুলতে দেয়া হতো না। ব্যাংকের রেটিং খারাপ হয়ে যেতো। ব্যাংক সরাসরি কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ করলে উদ্যোক্তা প্রতি ৫ থেকে ১০ রাখ টাকা ঋণ দিতে পারতো। আর যদি এনজিও হোলসেল লিঙ্কেজে ঋণ প্রদান করা হতো তাহলে ব্যাংক একটি এনজিওকে যত ইচ্ছে ঋণ দিতে পারতো।
সিডিউল ব্যাংকগুলো এনজিওর মাধ্যমে কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ করলে সে ক্ষেত্রেও প্রচলিত ব্যাংক ঋণের চেয়ে এক শতাংশ কম সুদ চার্জ করা হতো; কিন্তু এনজিওরা তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের নিকট ঋণ বিতরণকালে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ চার্জ করতো। অর্থাৎ কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ করে ব্যাংক লাভবান হতো। এনজিওরা লাভবান হতো; কিন্তু টার্গেট গ্রুপ যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তারা লোকসানের শিকার হতো। তাদের ব্যাংক রেটের চেয়ে অন্তত তিনগুন বেশি সুদে ঋণ গ্রহণ করতে হতো। বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি উত্থাপিত হবার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নির্দেশনা দিয়েছে সিডিউল ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব শাখার মাধ্যমে কৃষি ও পল্লি ঋণের অন্তত ৫০ শতাংশ বিতরণ করতে হবে।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে