নিয়াজীর চেহারায় ছিল রাজ্যের হতাশা, লজ্জা আর অপমান: এ.কে. খন্দকার
দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। শীতকালের দিন ছোট। দুপুর গড়ালেই সন্ধ্যা। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের এমন দুপুরে ঢাকা ক্যান্টমেন্টে জরুরি মিটিং-এ বসেছিলেন পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানি কমান্ডার এ.কে. নিয়াজী আর মেজর জেনারেল জ্যাকব। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ হবে খোলা মাঠে, জনতার মাঝে। ঐতিহাসিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে. খন্দকার। ১৯৭১ সালের তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ সর্বাধিনায়ক। বিকেল আনুমাননিক সাড়ে তিনটার দিকে বিমানবন্দরে জেনারেল অরোরাকে অভ্যর্থনা জানায়ি নিয়াজী। ঐ একই সময় কলকাতা থেকে আগড়তলা হয়ে ঢাকায় এসেছিলেন এ.কে. খন্দকার। অরোরার সাথে একই জিপে করে তিনিও সেখান থেকে সরাসরি যান সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। প্রত্যক্ষ করেন ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। আসুন তার কাছে থেকেই জেনে নিই হিরন্ময় সেই বিকেল বেলার কথা। সায়মন ড্রিং ও অন্যান্যের একাত্তর নামের এক গ্রন্থের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ এ.কে. খন্দকারের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি ২০১৬ সালের ২৩ জুন এ. কে. খন্দকারের উত্তরার বাসায় নেয়া।
রাহাত মিনহাজ : ডিসেম্বরের শুরুতে যুদ্ধ সম্পর্কে আপনারা কি ধারনা পাচ্ছিলেন?
এ.কে. খন্দকার : আমরা যখন সংঘঠিতভাবে যুদ্ধ শুরু করি তখন থেকেই জানতাম এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাজয় অনীবার্য। আর অক্টোবর-নভেম্বরে সর্বাত্মক যৌথ অভিযান শুরুর পর আমরা বুঝতে পারি পাকিস্তানের পরাজয় শুধুই সময়ের ব্যাপার মাত্র। ডিসেম্বরে এসেতো যুদ্ধ আরও গতি লাভ করে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করার পর আমরা সবাই নিশ্চিত হই, বাংলাদেশের অভ্যূদয় শুধুই ক্ষণ গণনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ পাকিস্তানের মনোবল ছিলো খুব নিম্ন পর্যায়ে। তাদের নৈতিক কোন অবস্থান ছিলো না। আর ভৌগোলিকভাবে খুবই বেকায়দায় থাকা এমন দুর্বল একটা বাহিনীকে পরাজিত করা যে খুব সহজ হবে তা আমরা জানাতাম।
রাহাত মিনহাজ: ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। গঠিত হয় যৌথ কমান্ড। আপনি সে সময় তাজউদ্দীন আহমদের পাশে থেকে যে সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই দিনের স্মৃতি যদি একটু বলেন?
এ.কে. খন্দকার : দেখুন যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা ভারতের বিশেষ সহযোগিতা পেয়েছি। আর ব্যাক্তিগত পর্যায়ে আমার সাথে অরোরাসহ অনান্যা উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তার সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল। আমি যতবার কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়েছি ততবারই তাদের উষ্ণ ব্যবহার পেয়েছি। যে কারণে তাদের সাথে কাজ করা আমার জন্য সহজ ছিল। আর যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর এই সম্পর্ক আরও জোরালো হয়। অনেকেই যৌথ কমান্ড গঠনের বিষয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন এটা জরুরি। সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ হয়ে আমিও বুঝতাম এই কমান্ড গঠন কৌশলগতভাবে আমাদের এগিয়ে রাখবে। যাই হোক কমান্ড গঠনের পর আমার পূর্বের সু-সম্পর্ক যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা ও সমন্বয়ে খুব কাজে দেয়।
আর ভারতের স্বীকৃতির দিন ছিল খুবই আনন্দের। ৬ ডিসেম্বর সকালে ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, আর ভারতের স্বীকৃতি আসে বিকেলে। আমরা জানাতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় স্বীকৃতি কতটা জরুরি। কাঙ্খিত এই স্বীকৃতি পেতে দেরি হওয়ায় আমাদের অনেকের মনে হতাশাও ছিল। যাই হোক ঐ স্বীকৃতির দিন কলকাতার ৮ নম্বার থিয়েটার রোডের প্রবাসী সরকারের কার্যালয়ে আনন্দের বন্যা বইয়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমদতো প্রেস কনফারেন্সেই কেঁদে ফেললেন।
রাহাত মিনহাজ: এবার চলে আমি ১৬ ডিসেম্বরে। ঐ দিন আপনি কোথায় ছিলেন। কিভাবে কখন ঢাকায় আসলেন। সাক্ষী হলেন ইতিহাসের।
এ. কে. খন্দকার : ঐদিন আমি কি কাজে যেন একটু বাইরে গিয়েছিলাম। সকাল ১০.৩০ এর দিকে আমি থিয়েটার রোডের কার্যালয়ে ফিরে আসি। আসতেই কয়েকজন আমাকে বলেন, এই আপনি কই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী (তাজউদ্দীন) আপনাকে খুঁজছেন। আমি দ্রুতই তাঁর কক্ষে যাই। আমাকে দেখে তিনি চেয়ার থেকে উঠে এলেন। বললেন, শোন আজই সারেন্ডার হবে। তোমাকে ঢাকা যেতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।
রাহাত মিনহাজ: সেনা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবেতো ঐ কাজ করার কথা জেনারেল ওসমানীর। আপনি কেন? অনেকেই ওসমানীর ঐ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে না যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন ধরণের কথা বলে। প্রশ্ন তোলেন। আপনি কি বলবেন?
এ. কে. খন্দকার: আমি যতদূর জানি ১৬ ডিসেম্বর ওসমানী সাহেব কলকাতায় ছিলেন না। তিনি মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে সিলেট এলকায় গিয়েছিলেন। তার সাথে ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত ও লেফটেনেন্ট কর্নেল আবদুর রব। তিনি কয়েকদিন আগে সম্ভবত ১৩ ডিসেম্বর মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেছিলেন। সে সময় আমি উনাকে বলেছিলাম, এই জরুরি সময় কলকাতার বাইরে না যাওয়াই ভাল। যদিও তিনি আমার এই পরামর্শ রাখেননি। তবে ঠিক কি কারণে তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জাননি তা বা ঐ অনুষ্ঠানে থাকতে আগ্রহী হননি তা আমার জানা নেই।
রাহাত মিনহাজ: কিভাবে, কখন আপনি ঢাকা পৌছালেন?
এ. কে. খন্দকার: আমার জন্য দমদম এয়াপোর্ট একটা ছোট্ট প্লেন অপেক্ষা করছিল। সে কথা তাজউদ্দীনই আমাকে বলেছিলেন। তাজউদ্দীনের ব্যক্তিগত সচিব ফারুক আজিজ খান, মেজর নুরুল ইসলাম ও ফ্লাইট লেফটেনেন্ট রেজা আমাকে এয়াপোর্টে পৌছে দেন। আমি যখন সিঁড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠেছি তখন দেখি একটা সামরিক জীপ প্লেনের দিকে আসছে। বুঝলাম এতে গুরুত্বপূর্ণ কেউ আছেন। জীপ কাছে আসতেই দেখতে পেলাম গাড়িতে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও তাঁর স্ত্রী বান্তি অরোরা। আমি তখন সিঁড়ি থেকে নেমে তাঁকে জায়গা করে দিলাম। কিন্তু অরোরা আগে আমাকেই সামনে এগিয়ে দিলেন। বললেন, আপনি মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার, আপনি আগে যাবেন। প্লেনে বসালেন তারপর নিজে বসলেন। ঐদিন অরোরার ঐ বিনয় আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছিল। ঐ ছোট্ট প্লেনে করে আমরা আগড়তলা পৌছালাম। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায়। যুদ্ধের সময় ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে সেখানে বিমান ওঠা-নামা করতে পারতো না। তবে হেলিকপ্টার নামতে পারতো। তাই আমরা আগড়তলা হয়ে ঢাকা যাই। আগড়তলা ছোট্ট বিমানবন্দরে বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার তৈরি ছিল।
রাহাত মিনহাজ: বিমানবন্দরে নেমে কি দেখলেন?
এ. কে. খন্দকার: বিমানবন্দরে অরোরাকে আমন্ত্রণ জানান নিয়াজী। এছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরও উর্দ্ধতন কর্মকর্তারাও ছিলেন।
রাহাত মিনহাজ: নিয়াজীকে কেমন দেখেছিলেন? কি বলছিলে তাঁর মুখাবয়বের ভাষা?
এ. কে. খন্দকার: নিয়াজী খুবইত বিষণ্ন ছিলেন। তাকে বিদ্ধস্ত, পরাজিত দেখাচ্ছিল। তবে সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘটছিল যে অনেক কিছু চাওয়া সত্ত্বেও পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ছিলো না।
রাহাত মিনহাজ: রেসকোর্স ময়দানে কখন পৌছালেন? কেমন ছিল ঢাকা পরিবেশ?
এ.কে. খন্দকার: বিমানবন্দর থেকে চার পাঁচটা জিপে করে আমাদের নেয়া হয় রেসকোর্স ময়দানে। রাস্তায় প্রচুর মানুষ। সবাই আনন্দিত। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আর আমাকে কয়েক জনতো বিমানবন্দরেই জড়িয়ে ধরেন। আলিঙ্গন করেন। বিজয় আলিঙ্গন। এরপর রেসাকোর্সে আসার পথেও এই অলিঙ্গন আর অভিবাদন চালু ছিল। ময়দানে পৌছার পর অভিবাদন জানানোর মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরে। ধন্যবাদ জানায়। চারদিকেই স্বাধীনতার আনন্দ। অনেকটা ঈদের মতো আনন্দ।
রাহাত মিনহাজ: কিভাবে সম্পন্ন হলো ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ?
এ. কে. খন্দকার: রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। নিরাপত্তাকর্মীদের খুবই হিমশিম খেতে হচ্ছিলো। এরইমধ্যেই বটগাছের নীচে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার আনা হয়। এরপর আসেন অরোরা আর নিয়াজী। লেফটেনেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা তখন অফিসার কমান্ডিং চীফ ইন্ডিয়া এন্ড বাংলাদেশ ফোর্সেস ইন দ্যা ইস্টার্ন থিয়েটার আর জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ঐ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি কিছু সেনাকর্তাও ছিলেন। আরোরা আর নিয়াজী চেয়ার বসলেন। হাতে আত্মসমর্পণের দলিল। টান টান উত্তেজনা। চারদিকে প্রচুর মানুষ। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। আমি খুবই চেষ্টা করে টেবিলের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হই। আমার পাশে (একটু সামনে) ছিলেন ভারতীয় নৌ বাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল এস এম নন্দা, পূর্বাঞ্চলের বিমান বাহিনীর কামান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান, তার পাশে ছিলেন জেনারেল জ্যাকব। দলিলে স্বাক্ষর করার জন্য কলম এগিয়ে দেয়া হয়। প্রথম দফা স্বাক্ষর করতে গিয়ে কালি বের হয়নি। পরে একটু ঝাঁকুনি দেওয়ার পর কলমে কালি আসে। স্বাক্ষর করেন নিয়াজী। পরে জানতে পারি এই স্বাক্ষরের জন্য অরোরা কলমটি কলকাতা থেকে এনেছিলেন।
রাহাত মিনহাজ: ঐ অনুষ্ঠান কতক্ষণের ছিল? এ নিয়ে আপনার বিশেষ কোন স্মৃতি আছে কি?
এ. কে. খন্দকার: তখন আসলে সবকিছুই দ্রুত ঘটছিল। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি খুবই স্বল্প সময়েই শেষ হয়েছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে অনুষ্ঠানটির স্থায়িত্ব ছিলো আধা ঘন্টারও কম।
স্বাক্ষর শেষে কোন এক অফিসার নিয়াজীকে তার অস্ত্র তুলে দিতে বলেন। এই সময় নিয়াজী খুবই লজ্জিত হন। পরে তিনি তার কোমর থেকে রিভলবার বের করে অরোরার হাতে তুলে দেন। এ সময় নিয়াজীর চেহারায় ছিল রাজ্যের হতাশা, লজ্জা আর অপমান। আর তখন নিয়াজীর হাত কাঁপছিল। আমি স্পষ্ট দেখলিাম দোর্দান্ত প্রতাপশালী নিয়াজীর হাত কাঁপছে। লজ্জা-অপমান আর অজানা শঙ্কায়।
রাহাত মিনহাজ: অনুষ্ঠান শেষে আপনি কি করলেন?
এ. কে. খন্দকার: আত্মসমর্পণ শেষেই নিয়াজীকে কর্ডন করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌছে দেয়া হয়। এরপর আমরা অরোরাসহ আবার বিমানবন্দরে যাই। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে আগড়তলা। আবার ছোট্ট প্লেনে করে কলকাতার দমদম এয়ারপোর্ট।
রাহাত মিনহাজ: সেখান থেকে ফেরার পর তাজউদ্দীন আপনাকে কি বললেন?
এ. কে. খন্দকার: দমদম থেকেই আমি সরাসরি চলে আসি আট নম্বর থিয়েটার রোডের অফিসে। তাজউদ্দীন আমাকে জড়িয়ে ধরেন। পিঠ চাপড়ে দেন। সাবাশ! বলেন। সবকিছুতেই অভূতপূর্ব এক অনুভূতি অনুভব করছিলাম। ক্ষণে ক্ষণে। এরপর ২৬ ডিসেম্বর আমি আবার ঢাকায় ফিরি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে