Views Bangladesh Logo

জাতীয় খেলা কাবাডির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

জাতীয় খেলা হিসেবে দেশের ৫২ ক্রীড়া ফেডারেশনের মধ্যে কাবাডির তো বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার কথা। গুরুত্বটা এতদিন কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। ‘পুস্তক বন্দি’ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথটা কি ক্রমেই চওড়া হচ্ছে জাতীয় খেলায়! ঘরে-বাইরে নানা আয়োজন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কার্যক্রমে অগ্রাধিকার পাওয়া, কাবাডি ঘিরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গুরুত্ব কিন্তু তেমন বার্তাই দিচ্ছে।

১০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া কমপ্লেক্স বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন ২০ বছরের জন্য বরাদ্দ পেতে পারে- একটা সময় এমনটি ছিল কষ্ট-কল্পনা! যেটা ছিল কষ্ট-কল্পনা, সেটা কিন্তু বাংলাদেশ কাবাডিতে বাস্তব! এতেই স্পষ্ট বর্তমান কাবাডি নিয়ন্তারা স্বপ্নদর্শী। বড় কিছু করতে হলে প্রথমে স্বপ্ন দেখতে হয়। সে স্বপ্নটা দেখছেন কাবাডি ফেডারেশন কর্মকর্তারা। কেবল স্বপ্ন দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা বাস্তবায়নের পথটাও চওড়া করতে হবে। তা না হলে কিন্তু প্রত্যাশিত সুফল আসবে না।

স্বাধীনতার পর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে কাবাডি পাদপ্রদীপের বাইরে থাকলেও এশিয়ান গেমস থেকে সবচেয়ে বেশি পদক এনেছে কিন্তু খেলাটি। গেমসের কাবাডি থেকে ৩ রুপা ও ৪ ব্রোঞ্জ জিতেছে লাল-সবুজরা। ক্রিকেট ও বক্সিংয়ের বাইরে একমাত্র ডিসিপ্লিন হিসেবে এশিয়ান গেমস থেকে পদক এসেছে কাবাডিতে। একটা সময় নিয়মিত পদক জয়ের পরও খেলাটির কার্যক্রম কিন্তু সেভাবে বিস্তৃত হয়নি; যেভাবে বিস্তৃত হলে অর্জনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যেত। কার্যক্রম বিস্তৃত না হওয়ার পেছনে বিগত দিনে কাবাডিকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ আদৌ আছে কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।

কারণ আপনি উদ্যোগ নেওয়ার পরই কোন কার্যক্রম সাফল্যের মুখ দেখতে পারে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কার্যকর উদ্যোগ খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। যে কারণে এশিয়ান গেমস এবং দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব দেখিয়েছে! ১৯৯০ সালে নিয়মিত ডিসিপ্লিন হিসেবে এশিয়ান গেমসে কাবাডি যুক্ত হয়। ২০০২ সাল পর্যন্ত পুরুষ বিভাগ থেকে পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে নারী কাবাডি গেমসে যুক্ত হওয়ার পর দুটি পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। তারপর থেকে এশিয়াডে থমকে আছে লাল-সবুজরা।

সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখার কার্যকরী উদ্যোগ ছিল না বলে ২০১৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশ মহাদেশীয় গেমসের কাবাডিতে পদকশূন্য। ২০১৮ সালের আসরে ১৪ ডিসিপ্লিনে ১১৭ জনের বহর পাঠিয়েও পদকশূন্য ছিল বাংলাদেশ। ২০২২ সালে ১৭ ডিসিপ্লিনে ১৮০ জনের বহর পাঠিয়ে অর্জনের খাতায় ছিল নারী ও পুরুষ ক্রিকেট থেকে জেতা দুটি ব্রোঞ্জ। কাবাডির অর্জনে ছেদ না পড়লে সর্বশেষ দুই সংস্করণে লজ্জার অধ্যায় কিছুটা গোছানো যেত! জাতীয় খেলা কাবাডিকে সঠিক পথে রাখার প্রচেষ্টা লক্ষণীয় ছিল বিগত দুটি কমিটির মাঝে।

এ সময় খেলাটি শক্ত আর্থিক ভিতের ওপর দাঁড়ালেও মাঠের কার্যক্রমে ঘাটতি ছিল। যে কারণে প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি জাতীয় খেলা। বিগত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাবাডিকে আর্থিকভাবে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা ছিল বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম নেওয়াজ সোহাগের। সেই শক্ত অবস্থানের কারণে বর্তমান কমিটি খেলাটিকে সাফল্যের পথে ফেরাতে নানা কার্যক্রম হাতে নিতে পারছে। যার অন্যতম একটি পূর্ণাঙ্গ কাবাডি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ ছিল এনএসসির কাছ থেকে গোপালগঞ্জ মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স ২০ বছরের জন্য লিজ নেওয়া।

প্রস্তাবিত কমপ্লেক্সে যুব উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে থাকবে সিনিয়র পর্যায়ে নারী এবং পুরুষদের উন্নত প্রশিক্ষণ সুবিধা। কোচ এবং রেফারি ছাড়াও অন্যান্য টেকনিক্যাল অফিসিয়ালদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম রাখা হবে এই কমপ্লেক্সে- এমনটাই জানিয়েছে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন। কেবল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নয়, প্রস্তাবিত এ কমপ্লেক্সকে বিশ্ব কাবাডির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চান বলে জানালেন বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এস এম নেওয়াজ সোহাগ।

‘অতীতে যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশে কাবাডির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কিন্তু ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। এ কারণে বিশ্ব কাবাডি ফেডারেশন এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশন বাংলাদেশকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে। আমরা তাতে সন্তুষ্ট থাকতে চাই না। আমরা চাই জাতীয় খেলা তার মর্যাদা নিয়েই থাকুক। এ কারণেই পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে বিশ্ব কাবাডির গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকে বাংলাদেশ’- বলছিলেন এস এম নেওয়াজ সোহাগ।

৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর প্রায় এক বছর আগে গঠিত হয়েছে বর্তমান কমিটি। এ সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এমন কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাকে ঘিরে কাবাডি সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী হতে পারেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এস এম নেওয়াজ সোহাগ বলছিলেন, ‘বর্তমান সরকার ঘোষিত তারুণ্যের উৎসব বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী জাতীয় যুব কাবাডি প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল। বালক ও বালিকা দুই বিভাগে অনূর্ধ্ব-১৮ বয়স বিভাগে পরিচালিত এ কার্যক্রমের আওতায় ছিল প্রায় ৭ হাজার উদীয়মান খেলোয়াড়। যার মধ্যে থেকে বালক ও বালিকা দুই বিভাগে ৫০ জন করে ১০০ খেলোয়াড় বাছাই করা হয়েছে।

মনোনীত খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে আসন্ন যুব এশিয়ান গেমসের দল চূড়ান্ত করা হবে। দুটি দলকে ঘিরে আমরা পদকের সম্ভাবনা দেখছি। তাছাড়া দল দুটি কিন্তু সিনিয়র জাতীয় দলের পাইপলাইন হিসেবে কাজ করবে।’ ক্ষমতা গ্রহণের পর বর্তমান কমিটি নেপালের বিপক্ষে পুরুষ ও নারী বিভাগে দুটি টেস্ট সিরিজ খেলেছে। ঘরের মাঠে পুরুষ দল নেপালের বিপক্ষে সিরিজ জিতলেও অ্যাওয়ে সিরিজে হেরেছে নারী দল। এপ্রিলে এ সিরিজ হারের আগে অবশ্য প্রাপ্তি ছিল শাহনাজ পারভিন মালেকার দলের- ইরানে আয়োজিত নারী এশিয়ান কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপের ব্রোঞ্জ জয়।

ওটাই ছিল নারী এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে লাল-সবুজদের জয় করা প্রথম পদক। অর্জনের খাতা সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে নিয়ে আগামী মাসে ভারতে নারী কাবাডি বিশ্বকাপ খেলতে যাবে লাল-সবুজরা। ৩ থেকে ১০ আগস্ট ভারতের হায়দরাবাদে এ আসর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ২২ থেকে ৩১ অক্টোবর বাহরাইনে অনুষ্ঠিত হবে যুব এশিয়ান গেমস। আসরের ছেলে ও মেয়ে- দুই ইভেন্টেই খেলার কথা বাংলাদেশের। উভয় বিভাগ থেকেই পদকের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি এক রেখায় মিলে গেলে তা বিশ্ব মঞ্চে কাবাডিতে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর বড় বার্তা হতে পারে। এ জন্য দুই বিভাগেই প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের কাবাডিতে সমন্বিত যে কার্যক্রম চলছে, তা সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে তো?

উত্তরে এস এম নেওয়াজ সোহাগ বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎ সবসময়ই অনিশ্চিত। আগামী দিনের কথা কিন্তু আমি, আপনি বলতে পারব না। এটা বলতে পারি- আমি যতদিন আছি, চেষ্টা চালিয়ে যাব।’ তারুণ্যের উৎসবের প্রথম পর্বে জাতীয় যুব কাবাডি প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্বে জাতীয় কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর পর এ আসর আয়োজনের মাধ্যমে দেশের কাবাডিতে বড় একটা ঝাঁকুনি দিতে চান বর্তমান কাবাডি নিয়ন্তারা।

ঘরোয়া লিগগুলো সচল না করে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের উদ্যোগী হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘একসঙ্গে তো সব আসর আয়োজন করা সম্ভব না। লক্ষ্য করলে দেখবেন, ধাপে ধাপে আমাদের সব কার্যক্রমই চলছে। আগামীতে ঘরোয়া লিগও আয়োজিত হবে।’ বিগত কমিটির রেখে যাওয়া ফান্ড ভাঙিয়ে চলছে বর্তমান কমিটি- এমন অভিযোগও তোলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম নেওয়াজ সোহাগ বলছিলেন, ‘বিগত কমিটি স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছে ৩ কোটি টাকা। সেটা ৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। অর্থ একদিকে খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে রিফিল হচ্ছে। আমি বরাবরেই বলে এসেছি, আবারও বলছি- বাংলাদেশ কাবাডিতে অর্থ কোনো সমস্যা না। দায়িত্ব গ্রহণের সময় ফান্ডের কী অবস্থা ছিল, দায়িত্ব ছাড়ার সময় কী অবস্থা দাঁড়ায়- সময় হলে সবই পরিষ্কার হবে। যিনি অভিযোগ করছেন, তাকে সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ করতে বলুন।’

মাহবুব সরকার: লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ