প্রেম, রাজনীতি এবং গ্যালোয়া ট্র্যাজেডি
প্রেম মানুষকে অমর করে, ভালোবাসতে শেখায়, প্রেম থেকেই মানুষ পৃথিবী গড়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রেম পবিত্র, প্রেম সুন্দর আবার সেই কখনো নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। প্রেমই প্রতারণার জাল বিছিয়ে মানব জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। কত প্রাণ প্রেমের বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়ে প্রতি বছর ঝরে পড়ে, তার খবর কে রাখে? সাধারণ মানুষের প্রেম-প্রতারণা হয়ত সমাজে অতটা প্রভাব ফেলে, কোনো এক শহরে অখ্যাত কোণে কিংবা অজপাড়াগাঁয়ে প্রতারিত প্রেমিক জীবন শেষ হয়ে গেল, তার খবর পৃথিবীকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না; কিন্তু মুখোশ প্রেমের বলি হয়ে যদি প্রাণ যায়, এমন এক মানুষের যার কাছে, গণিত বিজ্ঞান কিংবা পৃথিবী ঋণী, সেই বিশ্বাসঘাতকতার কালিমালিপ্ত প্রেমের করুণ কাহিনি, যুগ যুগ ধরে কিংবা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এসেও পৃথিবী সেই কলঙ্ক মুছতে পারে না৷
ফরাসি গণিতবিদ এভারিস্ট গ্যালোয়া নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে, প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে নিজের জীবনটা খুইয়ে ফেলেন মাত্র ২০ বছর বয়সে, তাকে একরাতের গণিতবিদ হিসেবে স্মরণ করে বিশ্ব আজও মাথা নোয়ায়। শিরি-ফরহাদ বা লাইলি-মজনুর ফ্যান্টাসি প্রেমের মতো গ্যালোয়ার প্রেম মানুষের মুখে মুখে হয়ত রটেনি; কিন্তু প্রেম অন্ধ হয়ে করেছিলেন, তা লোকগাথার চেয়ে কম বিস্ময়কর নয়। ২০ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে তিনি যা করেছেন, তাতে পৃথিবী তাকে মনে রাখত বলে মনে হয় না। তবে স্রেফ মৃত্যুর আগের রাতে যা করলেন, তা আজ গণিত-জগতের ইতিহাস। সে সময় রাজনৈতিক উত্তাপে টালমাটাল গোটা ফ্রান্স। একদিকে রাজতন্ত্র, অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রের হাতছানি। এই দুই চক্রের কবলে পড়ে সাধারণ ফরাসিরা তখন দিশেহারা। এই ঘটনা কিশোর গ্যালোয়ার মনে গভীর রেখাপাত করে। অন্যায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মে মনে।
এমনিতে ছিলেন শান্ত শিষ্ট স্বভাবের মানুষ; কিন্তু ১৬ বছর বয়সে তার ভেতরে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে। গণিতে মজে যান গ্যালোয়া। শুধুই গণিত। খেতে, বসতে, ঘুমাতে, ক্লাসে তার মনে গণিতই শুধু ঘুরপাক খেতে থাকে। নিত্য-নতুন গাণিতিক সমস্যা তার মস্তিষ্কে উদয় হয়। নিজে নিজেই করেন সেসবের সমাধান। খাতা-কলমে নয়, মগজের স্মৃতিকোষে লাইন বাই লাইন সাজিয়ে রাখেন; কিন্তু গণিত এভাবে নিজের মাথায় আটকে রাখার জিনিস নয়। প্রকৃতির রহস্য সন্ধানে, প্রকৃতি রহস্য বুঝতে গণিত ব্রহ্মাস্ত্র; কিন্তু মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে আটকে রাখলে, তা কোনো কাজেই আসবে না। তাই ধীরে ধীরে কিছু কিছু কাগজের পাতায় টুকে রাখেন। তৈরি করেন গবেষণাপত্র। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিখ্যাত এক গণিত জার্নালে গ্যালোয়ার প্রথম গবেষণাপত্র ছাপা হয়।
আরও লিখতে চান গ্যালোয়া, ছাপতে চান আরও সব আনকোরা গাণিতিক সমাধান। খুব শিগগিরই দাঁড় করিয়ে ফেলেন, আর দুটি গাণিতিক প্রবন্ধ। ছাপা হয়, দৃষ্টি আকর্ষিত হয় গণিত ইতিহাসের আরেক মহারথী অগাস্টিন লুই কশির। গ্যালোয়াতে মুগ্ধ কশি চেয়েছিলেন ফ্রান্সের ‘একাডেমি অব সায়েন্স’-এর সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা যেন পান গ্যালোয়া; কিন্তু বিচারকরা বাদ সাধেন। কারণটা রাজনৈতিক। গ্যালোয়ার বাবা নিকোলাস গ্যালোয়া ছিলেন প্রজাতন্ত্র পন্থি রাজনীতিবিদ। সদ্য বিদায় নেওয়া রাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ছিল তার; কিন্তু ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্র বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আবার ফিরে আসে রাজতন্ত্র। তবু নিকোলাসের জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। রাজতন্ত্রের ডামাডোলের মধ্যে নিজের এলাকায় নির্বাচনে জিতে মেয়র হন।
সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবেও নিকোলাসের সুনাম ছিল। লিখতেন বুদ্ধিদীপ্ত সব কবিতা। সেই কবিতা দিয়েই তাকে ঘায়েল করা হয়। রাজতন্ত্র পন্থিরা গাদাগাদা অশ্লীল কবিতা লিখে মেয়রের নামে ছাপাতে থাকে। অপমানিত ও লজ্জিত নিকোলাস আত্মহত্যা করে মনের জ্বালা মেটান। বাবার মৃত্যু ক্ষুব্ধ আর খ্যাপাটে করে তোলে গ্যালোয়াকে। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় না গিয়ে প্রতিবেশী বেশ কিছু উগ্র রিপাবলিকান সমর্থককে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজতন্ত্র পন্থিদের ওপর। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বদলে লেগে যায় দাঙ্গা! বাবার মৃত্যুর পর আরও একবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তাকে পুরস্কার বঞ্চিত করে। ফলে কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন গ্যালোয়া। প্রায় ছেড়েই দেন গণিতচর্চা। আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লেন রিপাবলিকান রাজনীতিতে।
১৮৩০ সাল। সারা ফ্রান্স তখন আবার উত্তাল রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে গ্যালোয়া যোগ দেন ‘ন্যাশনাল রিপাবলিকান গার্ড’-এ; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক, রিপাবলিকানদের রাজনীতি ঝুঁকে পড়ে জঙ্গিবাদের দিকে। বদরাগী গ্যালোয়া আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। প্রকাশ্যে ফরাসি সম্রাটকে খুন করার হুমকি দেন। রাস্তায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান নিষিদ্ধঘোষিত ‘ন্যাশনাল রিপাবলিকান গার্ড’-এর পোশাক পরে। গ্যালোয়ার নামে অভিযোগ দায়ের করা। বিচারে ছয় মাসের জন্য জেল হয় তার। সাজাভোগ করে ছয় মাস পর ফিরে আসেন বাড়িতে; কিন্তু ততদিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন গ্যালোয়া। অতিরিক্ত মদ্যপান, মাত্রা ছাড়ানো রাগ, ক্ষোভ, হতাশা তাকে পুরোপুরি ভঙ্গুর করে ফেলে।
এ সময় হঠাৎই তার জীবনে বসন্ত আসে, স্টেফেনি ফেলিসি নামে প্যারিসের বিখ্যাত সুন্দরী তার দিকে বাড়িয়ে দেয় প্রণয়ের হাত। গ্যালোয়ার ছন্নছাড়া জীবনটা যেন প্রাণ ফিরে পায় নতুন করে; কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যায়, লোকজন ফিসফিস করে- স্বনামধন্য ডাক্তার স্টেফেনি কেন গ্যালোয়ার মতো ভবঘুরে, খ্যাপাটে, মাতাল যুবকের প্রেমে পড়লেন? এর জবাব খুঁজে পান না কেউ। স্টেফেনি প্যারিসের এক ধনাঢ্যের বাগদত্তা। হবু স্ত্রী আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করছে, এটা যে কোনো পুরুষের অহমে ঘা দেবে। সেকালের ফ্রান্সে তো সেটা রীতিমতো ভয়ানক লজ্জা ও অপমানের। স্টেফেনির প্রেমিকের পৌরষে ঘা লাগে।
অপমানের জ্বালা মেটাতে তিনি গ্যালোয়াকে জানান ডুয়েলের আহ্বান জানান। গ্যালোয়াও বিনা বাক্যে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। সেকালের রীতিই ছিল এই, কারও সঙ্গে কারও ঠুকঠাক লেগে গেলেই ডুয়েলের প্রস্তাব করা হতো। আর সত্যিকারে পুরুষরা সেই আহ্বান খারিজ করতে পারে না। পৌরষে আঘাত লাগে, সমাজের বিদ্রুপের পাশাপাশি হারও স্বীকার করে নিতে হয়। গ্যালোয়াও হার মানার পাত্র নন; কিন্তু হায়, তিনি তো পিস্তল চালাতেই জানেন না! তখনকার দিনে ডুয়েল হতো পিস্তল দিয়ে। ডুয়েলে অংশ নেওয়া দুজন পরস্পরে মুখোমুখি দাঁড়ায়। খুব কাছাকাছি। পিস্তলে যার হাত যত ভালো, যে যত দ্রুত কোমর থেকে পিস্তল বের করতে পারে, জয়মাল্য তারই গলায় ওঠে।
আর পরাজিতের ভাগ্যে বিকল্প কিছু নেই, মৃত্যু ছাড়া। গ্যালোয়া ডুয়েলের প্রস্তাব গ্রহণ করেন বটে, কিন্তু জানেন নিজের সীমাবদ্ধতার কথাও। যে হাতে কলম দিয়ে গণিতের রাশি রাশি সমীকরণ বেরোয়, সে হাতে পিস্তল চলে না; কিন্তু জীবনের চেয়ে আত্মসম্মানকেই বড় করে দেখেন। প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দশজনের দুয়োধ্বনী শুনতে চান না। গ্যালোয়া জানতেন মৃত্যু তার অনিবার্য। সারা জীবন গণিতের পেছনে যেভাবে ছুটেছেন, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কি তা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে, তার সব আবিষ্কার। তাই ডুয়েলের আগের রাতে মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে সাজিয়া রাখা গণিতের সব ফরমুলা আর সমাধান লিখে ফেলেন কাগজের পাতায়।
পুরো রাতটা নির্ঘুম কাটে গ্যালোয়ার। সূত্র, তত্ত্ব, সমীকরণে ভরিয়ে ফেলেন দিস্তার পর দিস্তা কাগজ। আর সেসব তত্ত্বে মাঝেমধ্যে খেয়াল বশে লিখে রাখেন প্রেমিকার নাম। লিখতে লিখতে রাত পেরিয়ে যায়। ভোরবেলা তার সব সূত্র, তত্ত্ব লেখা শেষ হয়। সেগুলো একটা খামে ভরে পোস্ট করে দেন এক বন্ধুকে। সঙ্গে একটি চিঠি। তাতে বন্ধুকে অনুরোধ করেন, ডুয়েলে যদি তার মৃত্যু হয়, তার এসব কাজ যেন ইউরোপের বড় বড় সব গণিতবিদের কাছে পৌঁছে দেন।
১৮৩০ সালের ৩০ মে। যথারীতি ডুয়েলের ময়দানে হাজির গ্যালোয়া আর স্টেফেনির বাগদত্তা। দর্শকও আছে অসংখ্য। দুজনেই পিস্তল তোলেন পরস্পরের দিকে। ফল যা হওয়ার তা-ই হতো- একটি মাত্র গুলিতে প্রাণপাখি উড়ে যায় অসাধারণ গণিতবিদ এভারিস্ট গ্যালোয়ার। পড়ে থাকে গণিত নিয়ে করা তার সব কাজ। গ্যালোয়ার লাশ সৎকারের সময় ফের শহরজুড়ে আবার দাঙ্গা লাগে। গুঞ্জন ওঠে, স্টেফেনি গ্যালোয়ার সঙ্গে প্রতারণা করে, আসলে সে কখনো ভালোই বাসেনি তাকে। ফাঁদে ফেলে ডুয়েলের ময়দানে ঠেলে দেওয়ার প্রেম-প্রেম নাটকের অভিনয় করেছে। যে লোক ডুয়েলে লড়েছেন, তিনি নাকি স্টেফেনির বাগদত্তা নন, পেশাদার খুনি।
আসলে গ্যালোয়াকে হত্যা করা জন্য নিখুঁত চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছিল, এতে রাজতন্ত্র পন্থিরা সফল। গ্যালোয়ার সেই বন্ধু অনুরোধ রেখেছিলেন। শেষরাতে করা সেই কাজগুলো পৌঁছে দিয়েছিলেন ইউরোপের সেরা গণিতবিদদের কাছে। একটা কপি গণিতবিদ জোসেফ লিউভিলের কাছেও পৌঁছায়। তিনিই সক্ষম হয়েছিলেন গ্যালোয়ার লেখা গাণিতিক তত্ত্বগুলো সঠিকভাবে বুঝতে। প্রতিটি থিওরির সঠিক মর্মোদ্ধার করে সেগুলো ফ্রান্সের সেরা জার্নালে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তিনি। প্রকাশিত হয় সেসব কাজ। গ্যালোয়ার মৃত্যুর পর ততদিনে পেরিয়ে গেছে ১০ বছর। দুনিয়ার বাঘা বাঘা গণিতবিদরা বিস্ময়ভরা হৃদয়ে অনুধাবন করেন এক তরুণ গণিতবিদের জীবনের শেষ রাতের মহিমা।
আবদুল গাফফার রনি: বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে