Views Bangladesh Logo

প্রেম, হরর মুভি এবং হংকং-চায়না ম্যাচ!

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

ধুনিক ফুটবল এখন কেবল গোললাইন থেকে টাচলাইনে সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রযুক্তির, মনস্তাত্ত্বিক, কথার এবং কৌশলের লড়াই; কিছু ক্ষেত্রে কূট-কৌশলেরও। হংকং-চায়নার বিপক্ষে বাংলাদেশ যে ম্যাচটা খেলল, সেটা বিকেল কিংবা সন্ধ্যায়ও আয়োজন করা যেত; কিন্তু ম্যাচ রাত ৮টায় শুরু করার পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল- প্রতিপক্ষ দলকে সম্ভাব্য জটিলতায় ফেলা; ১৪ অক্টোবর অ্যাওয়ে ম্যাচের আগে ঝামেলার মধ্যে রাখার উদ্দেশ্যে।

কারণ, ম্যাচের দিন ঢাকা থেকে হংকং-চায়না যাওয়ার সর্বশেষ ফ্লাইট ছিল রাত ২টায়। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইট আবার এই রুটে সময়ের হিসাবে সবচেয়ে লম্বা- প্রায় ১৩ ঘণ্টা। থাই এয়ারওয়েজে শুক্রবার দুপুরের ফ্লাইটের টিকিট ছিল না। অতিথি দলের রেগুলার ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগের সহজ সমাধান ছিল ক্যাথে প্যাসিফিকের শনিবার বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটের ফ্লাইট। সে হিসেবে শুক্রবার দুপুরে রওনা দেওয়া বাংলাদেশ দলের সদস্যদের হংকং-চায়নায় আগে পৌঁছানোর কথা। অর্থাৎ ফিরতি লেগে প্রতিপক্ষের তুলনায় সতেজ হয়েই মাঠে নামার সুযোগ ছিল বাংলাদেশের সামনে।
কিন্তু বাংলাদেশকে সে সুযোগ দেয়নি প্রতিপক্ষ দল। ঢাকায় নামার পর হংকং-চায়না দলের তরফে মালদ্বীপ থেকে আসা ম্যাচ কমিশনার আহমেদ শাহিরকে জানানো হয়েছিল, ‘আমাদের ফ্লাইট শিডিউল বদলে গেছে- রেগুলার ফ্লাইটে নয়, চার্টার্ড ফ্লাইটে ফিরব আমরা।’ আধুনিক ফুটবলে একটা দলের এমন সক্ষমতা থাকা জরুরি; যেখানে দলের সুবিধার জন্য চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা মামুলি বিষয়। বাংলাদেশের চিত্রটা একবার ভাবুন- সস্তা ফ্লাইট খুঁজতে গিয়ে লম্বা ট্রানজিট নেওয়ার অতীত অভিজ্ঞতাও রয়েছে!

মুখোমুখি হওয়া দুটি দলের এই যখন অবস্থা, তখন মাঠের লড়াইয়ে তারতম্য তো থাকারই কথা। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো বাংলাদেশ-হংকং-চায়না ম্যাচ লাল-সবুজদের মুঠোভরে দিয়েছে। বাংলাদেশ লিড নিয়ে টানা তিন গোল হজম করেছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো ১৫ মিনিটের ব্যবধানে ৩-৩ করে ফেলা ছিল দুঃসাহসিক অভিযানের মতো। কিন্তু তীরে এসে তরী ডোবানোর পুরোনো অভ্যাস ত্যাগ করা যায়নি- অন্তিম মুহূর্তে গোল হজম করে ৩-৪ ব্যবধানে ম্যাচ হারা।

প্রেম নাকি হরর মুভির মতো- যেখানে ভালো লাগা এবং ভয় দুই অনুভূতি একসঙ্গে কাজ করে! এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ-হংকং-চায়না ম্যাচে ভয়ের দিক নেই, আছে কষ্ট ও ভালো লাগার অম্লমধুর অভিজ্ঞতা। ম্যাচটা নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে, আবার কষ্টও হয়। বৈশ্বিক ফুটবলে কষ্ট দূর করে ভালো লাগার মতো মুহূর্ত স্থায়ী করতে বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ।

‘এমন হারেও গৌরব আছে’- লাইনটা পড়ার পর নিশ্চয়ই গালাগাল শুরু করে দিয়েছেন! যদি তাই হয়, দয়া করে পরিসংখ্যানে চোখ রাখুন। গত ২০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের কোনো দেশের বিপক্ষে ৩ গোল করার রেকর্ড নেই বাংলাদেশের। সর্বশেষ দেড় দশকে বাংলাদেশ এক ম্যাচে তিন কিংবা তার বেশি গোল করেছে সাতবার। সব প্রতিপক্ষ ছিল ফুটবলে পিছিয়ে থাকা জনপদ- দক্ষিণ এশিয়ার দেশ। ভুটানের বিপক্ষে তিনবার, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুইবার এবং একবার করে পাকিস্তান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে। হংকং-চায়নার বিপক্ষে সর্বশেষ ২০০৬ সালের এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ২-০ গোলে হারতে হয়েছিল। এমন দলের বিপক্ষে ওভাবে লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ানোকে তো অসাধারণই বলতে হবে!

লাল-সবুজদের মাঝে অমন তেজ সর্বশেষ দেখা গেছে এক দশক আগে, ২০১৫ সালের বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপের ফাইনালে। তৎকালীন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ০-২ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে ২-২ করেছিল ডাচ কোচ লোডউইক ডি ক্রুইফের অধীনে খেলা বাংলাদেশ দল। জাহিদ হাসান এমিলি ও ইয়াসিন খানের কল্যাণে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করা ম্যাচের পরিণতি হয়েছিল একই- অন্তিম মুহূর্তে গোল খাওয়ার পুরোনো অভ্যাসে ৩-২ ব্যবধানে হার। সেদিনও গ্যালারি ছিল দর্শকপূর্ণ, দিনশেষে এক বুক হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছে স্বাগতিক সমর্থকদের।

আচ্ছা, বাংলাদেশের ফুটবলামোদীরা যে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা নিয়ে গ্যালারিতে হাজির হন, বর্তমান দলের কি তা পূরণ করার সামর্থ্য আছে? উত্তরটা বোধকরি নেতিবাচক! এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশ এখন অতীতের তুলনায় দল হিসেবে বৈচিত্র্যময়- হামজা চৌধুরী, সামিত সোম, ফাহমিদুল ইসলামের মতো প্রবাসী ফুটবলাররা আছেন। সর্বশেষ সংযোজন জায়ান আহমেদ অভিষেকেই নিজেকে রাঙিয়েছেন, সকলের হৃদয় জয় করেছেন।

সমস্যা হলো, ফুটবল একটি দলগত খেলা- ১১ জনের দলে একজন-দুজন ভুল করলেই ডুবতে হয় গোটা দলকে। হংকং-চায়নার বিপক্ষে ম্যাচে যেমনটা ঘটেছে। হামজা চৌধুরী, সামিত সোম, ফাহমিদুল ইসলাম, জায়ান আহমেদ, জামাল ভূঁইয়ার উজ্জ্বল উপস্থিতির বিপরীতে ফয়সাল আহমেদ ফাহিম, সোহেল রানা জুনিয়র, সাদ উদ্দিনরা ভুল করেছেন, আর ডুবেছে পুরো দল।

বাংলাদেশের এমন ভরাডুবির জন্য এককভাবে কাউকে দোষারোপ করাটা বোধকরি অন্যায় হবে। ফুটবলে কোচের অবস্থা অনেকটা ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’- দিন শেষে দায় নিতে হয় তাকেই। হংকং-চায়নার কাছে হারের পর দায় স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ দলের কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরা; কিন্তু ফয়সাল আহমেদ ফাহিম যদি হেড করে গোলমুখে প্রতিপক্ষের পায়ে বল তুলে দেন, তাহলে হাভিয়ের ক্যাবরেরা কেন; হোসে মরিনহো কিংবা পেপ গার্দিওলারও কিছু করার থাকে না। সোহেল রানা জুনিয়র ব্যাকপাস করতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে গোলটা থালায় সাজিয়ে দিলে, কিংবা সাদ উদ্দিনের পায়ের ফাঁকা দিয়ে বাড়ানো পাস থেকে গোল হলে, তখন কোচের কি-ই বা করার থাকে! ডিফেন্ডারের স্ট্যান্স ঠিক করা কি কোচের কাজ?

কোচের দায় রয়েছে টিম সিলেকশনে। এ জায়গায় হাভিয়ের ক্যাবরেরার সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ- কেন তিনি ইনজুরিগ্রস্ত সেন্টারব্যাক নিয়ে ২৩ জনের স্কোয়াড সাজালেন? কেন তিনি সাদ উদ্দিনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেখালেন? জামাল ভূঁইয়ার অভিজ্ঞতাকে কেন যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হলো না? ৪ জুন ভুটানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে উজ্জ্বল নৈপুণ্যের পর জামাল ভূঁইয়াকে আরেকটু পরখ করা যেত; কিন্তু ৪৫ মিনিট পরই তাকে তুলে নিয়েছিলেন কোচ। ১০ জুন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে ডেনমার্ক প্রবাসী এই মিডফিল্ডারকে পুরো ম্যাচে বেঞ্চেই বসিয়ে রাখেন স্প্যানিশ কোচ। হংকং-চায়নার বিপক্ষে ম্যাচে জামাল মাঠে নেমেই দৃশ্যপট বদলে দিয়েছেন- বিষয়টা এমন নয়। তবে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পথে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

হাভিয়ের ক্যাবরেরাকে নিয়ে সমালোচনার বড় অংশ এসেছে বাংলাদেশের তৃতীয় গোলের পর তার বুনো উল্লাসকে ঘিরে। উল্লাসে যোগ দিতে টেকনিক্যাল এরিয়া ছেড়ে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ ম্যাচ তখনো শেষ হয়নি। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি এই আচরণের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে ওভাবে উদযাপন করাটা পাগলামি ছাড়া কিছুই না। ওই সময়টাতে হংকং-চায়না প্রচণ্ড চাপে ছিল। বাংলাদেশের উচিত ছিল প্রথমে নিশ্চিত করা যে আমরা আর কোনো গোল হজম করব না। তারপর চাপ অব্যাহত রেখে বাকি সময়ে চতুর্থ গোলের জন্য ঝাঁপানো; কিন্তু আমরা দেখলাম ঠিক উল্টো চিত্র- খুশিতে আত্মহারা হয়ে মনোসংযোগ হারিয়ে বসা, চতুর্থ গোল হজম করে ম্যাচটা হারতে হলো।’ তবে এটাও জানিয়ে রাখি, ১-৩ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে ওভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতার প্রশংসাও করেছেন জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার এমিলি।

পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচটা এভাবে হারের পর যাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তাদের একজন কামাল বাবু। ঘরোয়া ফুটবলের প্রতিষ্ঠিত এই কোচ বলছেন, ‘যখন বাংলাদেশ দল নিশ্চিত হারের দ্বারপ্রান্তে, তখন প্রয়োজন ছিল একটি ম্যাজিকাল মোমেন্টের। সৃষ্টিকর্তা দয়ার ভান্ডার খুলে সামিত সোমের মাধ্যমে সেটা আমাদের দিয়েছিলেন; কিন্তু কিছু অপরিপক্ব কোচিং স্টাফের অতি আবেগি কর্মকাণ্ড সব শেষ করে দিল! সামিত সোম শেষ মুহূর্তে আমাদের ম্যাজিকাল মোমেন্ট এনে দেওয়ার পর কি দরকার ছিল প্রধান কোচ এবং স্টাফদের আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে যাওয়ার? তাদের তো তখন নিজ দল যাতে গোল হজম না করে- সে জন্য খেলোয়াড়দের সুসংহত, সংঘবদ্ধ করার কথা। ওই সময়ে আবেগে আপ্লুত হওয়ার কথা নয়। চতুর্থ গোল দর্শক, সমর্থকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।’

হৃদয়ে রক্তক্ষরণে হতাশ কামাল বাবুর কণ্ঠে ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ও, ‘আজ আমরা ফুটবল সংশ্লিষ্টরা সকল দর্শক, সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চাই- আপনাদের ভালো ফুটবল, একটি জয় কিংবা অন্তত ড্র উপহার দিতে না পারার কারণে। দয়া করে আপনারা আমাদের ছেড়ে যাবেন না। কারণ দর্শক, সমর্থকই খেলার প্রাণ। ইনশাল্লাহ- একদিন হয়তো আপনাদের সমর্থনেই অফিসিয়ালদের টনক নড়বে। ফুটবলের আকাশে আবারও আবির্ভাব ঘটবে ঝলমলে সূর্যের।’

মাহবুব সরকার: লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ