কহলীল জিবরান ও হৃদয়ের আধিপত্য
কহলীল জিবরান যা লিখেছেন তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়; জিবরানের একেকটি গ্রন্থ পাঠ শেষে এমন প্রশ্ন বড় করে সামনে আসে। এর প্রধান কারণ, স্থান-কাল-পাত্রের সংযোগ এবং ঐক্যকে তিনি তার রচনা থেকে বাতিল করেছেন। তিনি প্রত্যক্ষ অনুষঙ্গ তথা বস্তুগত উপাদানকে বাদ দিয়ে জীবন ও হৃদয়কে এমনভাবে আখ্যায়িত করেছেন যা ব্যাষ্টিক নয় সামষ্টিক এবং খণ্ডকালীন নয় বরং চিরকালীন। আমরা বিচ্ছেদে আক্রান্ত প্রেমিকের হৃদয়ের অশ্রুপাতকে কিঞ্চিত অনুভব করতে পারি; কিন্তু জিবরান পাঠে মনে হয়, প্রেমিকের ব্যথিত হৃদয় বিবৃত করছে তার রোদন এবং যা অক্ষরে উঠে এসেছে তা যেন বিরহী-হৃদয়ের রক্ত দিয়ে লেখা। হৃদয়কে এমন বিদীর্ণ ভাষণে, এমন ঋদ্ধ কথামালায় উন্মুক্তভাবে প্রকাশ করতে জিবরানের পূর্বে ও অদ্যাবধি কাউকে দেখিনি। অন্য লেখকদের রচনায় যেখানে মস্তিষ্ক-প্রসূত চিন্তা, অভিজ্ঞতা, বস্তুজগৎ, প্রকৃতি, বিশ্বব্যবস্থা, রাজনীতি, অগ্রগতি ও মানুষের জীবনচিত্রের প্রভাব কিংবা প্রাবল্য দেখা যায়, সেখানে জিবরানে রয়েছে হৃদয়ের ক্রন্দন, উৎপীড়ন ও আধিপত্য। এই আধিপত্য বস্তু-বীক্ষণ কিংবা সম্রাজ্যের চেয়ে কম নয়, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জিবরানের অসংখ্য পাঠকের চিন্তায় তার প্রভাব সেটা জানান দেয়। জিবরান তার বর্ণনার জন্য যে ভঙ্গি (ফরপঃরড়হ) বেছে নিয়েছেন সেটিও সাহিত্যের প্রচলিত ভাষার অনুগামী ছিল না। অনেক বিশ্লেষক মত দিয়েছেন, জিবরান আরবি, বাইবেল ও পবিত্র কোরআনের গভীর পাঠ নিয়েছেন এবং যে প্রকাশরীতিতে তিনি ভাবনাগুলো প্রক্ষেপণ করেছেন তা ধর্মগ্রন্থদ্বয়ের ভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত। তিনি এমন সময়ে হৃদয়বৃত্তি ও আধ্যাত্মিকতাকে প্রকাশ করেছেন যখন ভোগ ও বস্তুবাদ পৃথিবীতে জেঁকে বসেছে, যদিও এ বৈপরীত্য তার প্রজ্ঞার স্ফুরণকে মোটেও দমিয়ে রাখতে পারেনি। জিবরানের মধ্যে অভূতসম্ভব দৃশ্য সৃজন, স্বপ্নময়তা এবং প্রগলভতার বিস্তার ছিল যা তার পিয়াসুদের নিকট আকর্ষণের হলেও অনেক সাহিত্য সমালোচক এজন্য তাকে ঝবহঃরসবহঃধষ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
জিবরান পশ্চিমা বস্তুবিশ্বের সামনে প্রাচ্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে পূর্বে ও পশ্চিমের মাঝে একটি অন্তরীণ সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছেন যেখানে তার সাফল্যকে বিশেষমাত্রায় চিহ্নিত করা যায়। দিনশেষে মানুষ তার নিজের দিকে তাকাবে এবং ভাববে সময় ও ভেতরের অনুরণন সম্পর্কে সেখানে কবি ও শিল্পীরা তার সামনে তুলে ধরবে স্বপ্ন ও অনুভূতির বিচিত্র ডালপালা। কবি ও শিল্পীরা মূলত হৃদয়ের এই দাবিকেই নানাভাবে আখ্যা দেয় এবং প্রয়োজনীয় করে তোলে। কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং প্রায় একই কথা বলেছেন তার ‘কবি’ প্রবন্ধে- ‘একজন কবি কিংবা শিল্পী তার সময়ের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে থাকেন এবং এ কারণেই শিল্পীর কাছে তার শিল্পকর্ম নিজের জীবনের চেয়েও অধিক মূল্যবান মনে হয়, যদিও তিনি সবসময় তা উপলব্ধি করতে পারেন না।’
চিন্তার উদ্গম ও উৎকর্ষ ছাড়া, হৃদয়ের জাগরণ ছাড়া যে শিল্প কেবল বস্তুবিশ্ব ও তার কর্ম-প্রবাহ নিয়ে গড়ে ওঠে তা অনেকটা জড় এবং প্রাণহীন পুতুলের মতো, সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারলেও সহসা সেটা তাৎপর্য হারিয়ে লুপ্তপ্রায় বিষয়ে রূপান্তরিত হয়। চিরকালীন সাহিত্য ও শিল্পকর্ম বলে আমাদের সামনে প্রাচীন যেসব কর্ম আজও তাৎপর্যের সঙ্গে চর্চিত তা সৌন্দর্য বীক্ষণের পাশাপাশি তার আধ্যাত্মবোধ, অভিজ্ঞান ও নৈতিক উৎকর্ষের জন্যই আদৃত। বেনেদেত্তো ক্রোচে, শিল্প-সমালোচনার ক্ষেত্রে গভীরভাবে শিল্পীর অধ্যাত্ম সত্তার পর্যালোচনা করেছেন। তিনি মনে করতেন শিল্পে অধ্যাত্ম সাধনারই প্রস্ফুরণ ঘটে। এছাড়া তিনি যাবতীয় শৈল্পিক ক্রিয়াকলাপকে ‘অপঃরারঃু ড়ভ ঝঢ়ৎরঃ’ তথা অধ্যাত্মকর্ম বলে আখ্যা দিয়েছেন। এসব মূল্যায়ন দৃষ্টির আলোকে কহলীল জিবরানের সাহিত্য ও চিত্রকর্ম অধ্যাত্ম ও হৃদয়বৃত্তির অফুরান উৎস যেখানে কালের কল্লোল কিংবা যুগের আগ্রাসনের চেয়ে হৃদয়ের অনুশাসন শক্তিমত্ত। তার রচনায় ব্যক্তির হৃদয় যেন ব্যক্তির মতো একান্তভাবে আসেনি, এই ব্যক্তি যেন অনিঃশেষ, অন্তহীন তার বিস্তার। লক্ষ-কোটি মানবসমষ্টির বিপরীতে এই একক হৃদয়েরও বৃহৎ বাসনা আছে, তাৎপর্য আছে আর সেটিকে মুক্ত করে দিতেই সক্রিয় ছিল তার শিল্পপ্রয়াস।
(দুই)
দ্য ওয়ান্ডারার- গ্রন্থে ‘নর্তকী’ শীর্ষক ফেবল-এ নৃত্যের অভিনবত্বের উৎস সম্পর্কে রাজকুমারের প্রশ্নের জবাবে নৃত্যশিল্পী উচ্চারণ করেন-‘দার্শনিকের আত্মা বসবাস করে তার মস্তিষ্কে, কবির আত্মা বসবাস করে তার হৃদয়ে, গায়কের আত্মা বিলম্বিত হয় তার কণ্ঠনালির জন্য; কিন্তু নর্তকীর আত্মা থাকে তার পুরো শরীরের সঙ্গে।’ কবির আত্মা থাকে তার হৃদয়ে; এই বিবৃতিুকু আমরা জিবরানের সমগ্র রচনায় এবং চিত্রকর্মে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করব। লেখায় পরিপার্শ্ব সৃজনের ক্ষেত্রে তিনি সময়হীন ভৌগোলিক বিচরণের মধ্য দিয়ে যেসব বাস্তব পাটভূমিকে বেছে নিয়েছেন তার পুরোভাবে লেবানন, মাউন্ট সান্নাই-এর ওপর চন্দ্রশোভা, সমুদ্র থেকে বিবলজের দৃশ্য, চিরহরিৎ বনভূমির তুষারে ঢেকে যাওয়া, শ্যামল উপত্যকার নিচে মেষ ও গাভীদের বিচরণ কিংবা কেদিসা উপত্যকায় প্রচণ্ড ঝড়। এসব খণ্ড স্থানিকতার মধ্য দিয়ে জিবরান যে হৃদয়-বিশ্ব সৃজন করেছেন, এ পর্যায়ে আমরা তার বিভিন্ন অংশ পাঠের মধ্য দিয়ে সে বিশ্বকে অনুভবের চেষ্টা চালাব।
সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় জিবরানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম দি প্রফেট, এটি পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত এবং পঠিত গ্রন্থগুলোরও একটি। এর মাহাত্ম সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী বিপুল আলোচনা হয়েছে, এটি এমনকি জিবরানকেও আক্রান্ত করেছে, তার নিজের মন্তব্য যেন তেমনই প্রকাশ করে: ‘প্রকাশকের হাতে পাণ্ডুলিপিটি তুলে দেয়ার আগে আমি চার বছর সময় চেয়েছিলাম, যেন প্রতিটি শব্দের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম শব্দটি আমি প্রয়োগ করতে পারি।’
একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপদেশে নির্বাসিত ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র আল মুস্তাফা স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য বারো বছর ধরে অপেক্ষা করছেন। এই বারো বছরে অর্ফালিজের জনগণের সঙ্গে তার মধুর সখ্য গড়ে ওঠে, তারা সকলে তাকে নিজের মনে করে এবং হারাতে চায় না তাকে। নানা কথকতার মধ্য দিয়ে যখন তার প্রত্যাবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে, তখন এক রমণী তাকে বিনীতভাবে বললেন- ‘তুমি চলে যাবার আগে তোমার কাছ থেকে আমার এটুকু চাইছি যে, তুমি আমাদের কিছু বলো, তোমার সত্য থেকে আমাদের কিছু দাও। এবং আমরা তা দেবো আমাদের সন্তান-সন্ততিদের আর তারা তাদের সন্তান-সন্ততিদের, এবং তা কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে না।’ তারপর তিনি প্রশ্নের জবাবে ২৬টি বিষয়ে তার প্রজ্ঞান ব্যক্ত করলেন এবং যা একশত বছর পেরিয়ে আজো মানুষকে আত্মিক জাগরণে ঋদ্ধ করছে। ভালোবাসার বিষয়ে তিনি বললেন: ‘ভালোবাসা, নমনীয় না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের ময়দার মতো পিষে ফেলে এবং তারপর তার পুত-পবিত্র অগ্নির দায়িত্ব অর্পণ করে তোমাদের, যা তোমাদেরকে পবিত্র রুটিতে পরিণত করতে পারে ঈশ্বরের ভোজ উৎসবের জন্য।’ তারপর আলমিতরা বলল, বিয়ে সম্পর্কে প্রভূ, তিনি বললেন- ‘তোমাদের রুটি তোমরা ভাগাভাগি করো একে অন্যের সাথে কিন্তু একই রুটি প্রত্যেকে খেয়ো না। একসঙ্গে নাচে, গাও এবং উল্লসিত হও; কিন্তু একা হতে দাও তোমাদের নিজেদের। যেমন বীণার তারগুলো নিঃসঙ্গ হলেও একই সুরের সঙ্গে তারা কেঁপে ওঠে।’
আজকাল আমরা সমাজে দেখছি, ছেলেমেয়েদের ওপর পিতামাতারা তাদের আকাক্সক্ষার ভার চাপিয়ে দিচ্ছে। পিতামাতার ইচ্ছে ডাক্তার হবে অথচ ছেলেটি চায় সে শিল্পী হবে। কোনো ছেলে পড়তে চায় বিজ্ঞান তাকে বাধ্য করা হয় আইন পড়তে। এ বিষয়টি নিয়ে ‘শিশুদের বিষয়ে’ অধ্যায়ে চমৎকার বিবৃতি উচ্চারিত হয়েছে। ‘তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে নয়। আর তারা তোমাদের সাথে থাকলেও তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদের ভালোবাসা দিতে পারো তোমাদের চিন্তাভাবনা নয়, কারণ তাদের নিজ নিজ চিন্তাভাবনা রয়েছে।’
এক নারীর আহ্বানে তিনি যন্ত্রণা সম্পর্কে বললেন, ‘তোমাদের যন্ত্রণা হচ্ছে সেই খোলসের ভাঙন, যে খোলস তোমাদের বোঝাবুঝিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। তোমাদের অধিকাংশ যন্ত্রণা তোমাদের বেছে নেয়া। চিকিৎসককে বিশ্বাস করো এবং পান করো তার প্রতিষেধক, নীরবতা ও প্রশান্তির ভেতরে কেননা ভারি ও শক্ত হলেও এ হাত পরিচালিত হয় অদৃশ্যের কোমল হাত দ্বারা এবং যে পেয়ালা সে বহন করে তা তোমাদের ঠোঁট জ¦ালিয়ে দিলেও তা নির্মিত হয়েছে সেই কাদামাটি দিয়ে যা কুম্ভকার নিজের পবিত্র অশ্রুবিন্দুতে ভিজিয়েছে।’
এক কবির প্রশ্নের জবাবে তিনি সৌন্দর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমে সৌন্দর্যকে বিভিন্ন মানুষ যেভাবে বিশ্লেষণ করে তা বিবৃত করলেন, যেমন- নিপীড়িতা বলে, সৌন্দর্য হচ্ছে দয়ালু এবং বিনয়ী। রাতের পাহারাদার বলে সৌন্দর্য ভোরবেলার সঙ্গে উদিত হবে পূর্বদিক থেকে। এসব ভাবনা বিষয়ে তিনি বললেন- ‘সত্যের ভেতরে তোমরা তার সম্পর্কে বলো নি যতা বলেছ অতৃপ্ত বাসনা সম্পর্কে।’ তারপর তিনি সৌন্দর্যের প্রকৃতরূপ তুলে ধরলেন- ‘সৌন্দর্য হচ্ছে একটি উত্তপ্ত হৃদয় ও একটি মন্ত্রমুগ্ধ আত্মা। হে অর্ফালিজবাসী, সৌন্দর্য হচ্ছে জীবন, যখন জীবন তার পবিত্র মুখমণ্ডল অনাবৃত করে। কিন্তু তোমরাই জীবন এবং তোমরাই হলে অবগুণ্ঠন। সৌন্দর্য হচ্ছে অনন্তকাল, দর্পণের ভেতরে যা স্থিরদৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তোমরাই হলে অনন্তকাল এবং তোমরাই হলে দর্পণ।’
কহলীল জিবরানের আরেক সুখ্যাত গ্রন্থ ‘বালি ও ফেনা’ এই গ্রন্থের মধ্যে আমরা কবির আত্মোপলব্ধি-জাত জীবনবোধের সাক্ষাত পাই। ম্যাক্সিম-ধারায় রচিত ছোট ছোট কাব্যিক গদ্যের (চড়বঃরপ চৎড়ংব) এ গ্রন্থে সমুদ্রতীরে বালি ও ফেনার যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অবস্থান তার মতোই জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে দার্শনিক বিবৃতি ও অভিজ্ঞান প্রকাশ পেয়েছে। আমরা বর্তমানে থাকলেও হাজার হাজার বছর অতিক্রমণের ইতিবৃত্ত আমাদের অন্তরালে সক্রিয় রয়েছে। ‘আমরা আকুল আকাক্সক্ষার প্রাণীরা অস্থিরভাবে চলাচল করছিলাম, হাজার হাজার বছর আগে সমুদ্র ও অরণ্যের বাতাস আমাদের দান করেছিল শব্দগুলি। বর্তমানে কীভাবে আমরা শুধুমাত্র গতকালের ধ্বনিগুচ্ছ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি আমাদের দিনগুলোর প্রাচীনতা?’ এটা মানুষ বোধ করে যে আত্মা অমর, অনিঃশেষ তবে আত্মার সূচনা কখন কীভাবে তা আজো মানুষের কাছে অজানা। ‘বালি ও ফেনা’র একটি স্তবকে আত্মার আবর্তন সম্পর্কে যে বিবৃতি উঠে এসেছে তা রহস্যজনক ও চমকে দেয়ার মতো নাটকীয়তাপূর্ণ: ‘আমার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে যখন আমার আত্মা ও শরীর পরস্পরকে ভালোবেসেছিল এবং বিয়ে করেছিল।’ মানুষের স্বপ্নের মাহাত্ম্যকে বারবারই জিবরান অতীব তাৎপর্যের সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেক পরিসম্পদ এমনকি প্রতিপত্তিকেও তুলনা করেছেন স্বপ্নের ঐশ্বর্যের সঙ্গে। তার মতে দুজন লোকের স্বপ্নের তাৎপর্য ও অবস্থান তাদের নিজেদের আত্মিক অবস্থান নির্দেশ করে। অন্য কিছুতে হতে পারে তবে জীবন স্বপ্নের ব্যাপারে অন্তত পক্ষপাতি নয়, তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীর ওপরে যারা ঘুমায় তাদের স্বপ্নের চেয়ে, পালঙ্কের ওপরে যারা ঘুমায় তাদের স্বপ্ন যখন অধিক সুন্দর হয় না, তখন কীভাবে আমি জীবনের ন্যায়পরায়ণতার ওপর থেকে বিশ্বাস হারাতে পারি।’ জিবরানের কিছু কিছু পঙ্ক্তিতে উল্লেখ্য বিবৃতিকে সাধারণ অর্থে মূল্যায়ন করা যায় না। এর মধ্যে এমন কিছু বিপরীত নির্দেশ ক্রিয়াশীল যা তার অন্তর্গত অর্থ উদ্ধারে বাধা সৃষ্টি করে হয়ত এটিও একটি রহস্য কিংবা অবগুণ্ঠন যা তার নির্যাসকে সুরক্ষিত রেখেছে। ‘সেই হল প্রকৃত অর্থে একজন মুক্ত মানুষ, যে ধৈর্যের সঙ্গে দাসত্ব বন্ধনের বোঝা বহন করে।’ আমরা অনেক সময় নিজকে আলাদা ভাবি, বিশেষ মনে করি অথচ আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি ক্রিয়াকর্ম অন্যের ওপর নির্ভরশীল, এ বিষয়ে একটি স্তবকে দারুণ ভাষ্য ধ্বনিত হয়েছে, ‘তোমার সবচেয়ে উজ্জ্বল পোশাকটি বয়ন করেছে অন্য ব্যক্তি, তোমার সবচেয়ে আরামদায়ক বিছানাটা রয়েছে অন্য ব্যক্তির বাড়িতে। এমন আমাকে বলো কীভাবে তুমি তোমাকে আলাদা করবে অন্য ব্যক্তি থেকে।’ মুখরতার মধ্যে সাময়িক চটক থাকতে পারে কিন্তু নীরবতার মধ্যেই প্রজ্ঞার ঐশ্বর্য বিরাজমান, এমন কথাই অভিনব ভঙ্গিতে উঠে এসেছে একটি পঙ্ক্তিতে ‘যদিও কথার ঢেউ চিরকাল আমাদের ওপরে আছে; কিন্তু আমাদের গভীরতা চিরকালই নীরব।’
সম্পদের মালিকানা ও অধিকার বিষয়ে কোনো কোনো চিন্তক এমনকি অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন, সম্পদের মালিকানা সকলের সমান। ধনিকের উদ্বৃত্ত সম্পদের ওপর ধনশূন্যদের অধিকার রয়েছে যদিও এসব বার্তা কেবল পুস্তকে রয়েছে, বাস্তবে কিছুই ফলে না। দান করার ক্ষেত্রেও যে সংযত এবং বিনীত থাকতে হয়, তার এক উদারনৈতিক দৃষ্টান্তের সাক্ষাত পাওয়া যায় ‘বালি ও ফেনা’ গ্রন্থে। ‘বস্তুতপক্ষে তুমি জনহিতকর কাজ করে থাকো বিশেষ করে যখন তুমি দান করো এবং যখন দান করো তোমার মুখখানা তখন ঘুরিয়ে রেখো যেন গ্রহীতার লজ্জা তোমাকে না দেখতে হয়।’
বস্তুব্যবস্থা এবং যুগযন্ত্রণার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে ব্যস্ত-সমস্ত দিনযাপন করলেও কিন্তু প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে একটা মরমী ব্যাপার আছে, কহলীল জিবরান সেটিকে কেবল একটু উসকে দিয়েছেন তারপর হৃদয়গুলো নিজের আগুনে জ¦লে উঠলো। এ যেন রবীন্দ্রনাথের গানের মতো- ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে। সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে।’ জিবরানের এ ইন্ধন কতা শক্তিশালী বিশ্বময় তার প্রভাব দেখেই বোধ করা যায়। ‘বিটুইন নাইট এন্ড মর্ন-’ গ্রন্থের ‘প্রচণ্ড ঝড়’- গল্পে তিনি সভ্যতার মেকি-মুখোশ খুলে দিয়েছেন। মানুষ যে শরীরের তাড়নায় নির্লজ্জভাবে খুন্নিবৃত্তিকে বেছে নিয়েছে অন্তরের সাড়া উপেক্ষা করে জিবরান তার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন ইউসিফ আল ফাখরীর বয়ানে এবং তার জীবনযাপন প্রক্রিয়ায়। ইউসিফ তার বিষয়ে জানতে আগ্রহী যুবককে বলেন- ‘আমি সভ্যতা পরিত্যাগ করেছিলাম, কারণ আমি লক্ষ করেছিলাম যে এটা একটা বৃদ্ধ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বৃক্ষ, শক্তিশালী এবং ভয়াবহ, যার শিকড়গুলি মাটির অস্পষ্টতার কারণে নিষ্ক্রিয় এবং যার শাখাগুলো পৌঁছেছে মেঘেরও ওপরে, এর ফুটে থাকার কারণেই লোভের জন্ম হয়। শয়তান খারাপ চিন্তা করে এবং অপরাধের জন্ম হয়; তার ফলগুলো হচ্ছে দুঃখ, দুর্দশা এবং ভীতি।’ ইউসিফ সভ্যতার মুক্তির জন্য নির্জনতাকে বেছে নিয়েছেন, মানুষ পরিশুদ্ধ হবে এ আশায় সে অপেক্ষমান। ‘এমন সময় কি আসবে যখন মানুষ স্থির হবে এবং মেনে চলবে সত্যের ডান হাতকে এবং উল্লসিত হবে দিবালোকে ও রাত্রির শান্তিপূর্ণ নৈঃশব্দের ভেতরে? স্বপ্ন কি বাস্তবে পরিণত হতে পারে? এটা কি বাস্তবায়িত হবে মানুষের চামড়ায় পৃথিবী ঢেকে যাবার এবং তা রক্তে সিক্ত হবার পর?’
ব্রোকেন উইংস’ কহলীল জিবরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আখ্যানের নাম। অনেক সমালোচক এ রচনাকে তার আত্মজৈবনিক কাহিনী বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এটি মূলত ভালোবাসার এক অনুপম গল্প যেখানে তাদের আনন্দ- বেদনায় কেবল তাদের হৃদয় নয় কেঁপে ওঠেছে পাঠকের অন্তরাত্মাও। জিবরান ও সেলমা কারিমি এ গল্পের প্রেমিক যুগল যাদের প্রেমের পথে তাদের পরিবারের কেউ নয় বরং বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গির্জার বিশপের অন্যায় আধিপত্য, যা ওদের হারিয়ে দেয় এবং সে বিচ্ছেদ ওদের উড়ন্ত ডানাগুলো ভেঙে ফেলে। সেলমার বিয়ে ঠিক হয়ে মনসুর বেই নামে বিশপের বখে যাওয়া এক ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে। শেষবার ওদের সাক্ষাতের সময়Ñ ‘তার ঠোঁটগুলো দেখাচ্ছিল শুকিয়ে যাওয়া দুটি গোলাপফুলের মতো, শরৎ যাকে বোঁটার সঙ্গে ফেলে রেখে গেছে। তার গ্রীবা ছিল হাতির দাঁতের তৈরি স্তম্ভের মতো এবং তা সামনের দিকে ঝুঁকে ছিল যেন তার মর্মবেদনার বোঝা মস্তিষ্ক তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।’ তারা দুজনেই পাশাপাশি বেঞ্চিতে বসল, পরস্পরের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল, তাদের কথা যেন শেষ হয়ে গেছে; দীর্ঘ নীরবতার পারে সেলমা মূর্ছিতস্বরে বলল, ‘হে আমার বন্ধু আমার দিকে তাকাও। ভালো করে পর্যবেক্ষণ কর আমার মুখমণ্ডল এবং সেখানে পাঠ করো যা তুমি জানতে চাও এবং যা আমি বলতে পারছি না। আমার দিকে তাকাও হে আমার প্রিয় মানুষ, আমার ভাই, আমার দিকে তাকাও।’ এখানে সেলমার কণ্ঠে উচ্চারিত ‘ভাই’- শব্দটি যেন এক উচ্চতর ব্যঞ্জনায় হৃদয়ে লেগেছে। বিচ্ছেদের দুর্দশায় ওরা প্রার্থনা করে: ‘আহ্, হে ঈশ্বর দয়া করুন এবং আমাদের পাখাগুলি মেরামত করে দিন।’ ব্রোকেন উইংস-এর শেষ অংশটি যে কোনও ট্র্যাজেডির পরিণতিকেও হার মানায়। কন্যাসন্তান হয়েছিল সেলমার কিন্তু শিশুটি ভোরবেলা এসে সূর্য ওঠার পরেই মারা যায়। মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে সে বলল, ‘আমাকে নিয়ে চলো এবং এসো আমরা এই অন্ধকার গুহা পরিত্যাগ করি।’ কিছুক্ষণের মধ্যে সেলমাও কন্যার সঙ্গে সহগমনের অধিকার পেয়ে যায়। তাদের দাফন শেষে সবাই চলে গেলে গোরখোদকের সঙ্গে জিবরানের যে সামান্য কথা হয় তা এখানে তুলে ধরছি। “আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, ‘তোমার কি মনে আছে ফারিস ইফান্দি-কে (সেলমার পিতা) কোথায় সমাহিত করা হয়েছিল? সে একমুহূর্ত আমার দিকে তাকাল। তারপর সেলমার কবরের দিকে আঙুল তুলে বলল, ঠিক ঐখানে। আমি তার কন্যাকেও একই জায়গায় রেখেছি। ঠিক তার ওপরে এবং তার কন্যার বুকের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে তার শিশুসন্তান। তারপর মাটিচাপা দিয়েছি।’ তার কথা শেষে আমি বললাম, ‘এই গর্তের ভেতরে তুমি আমাকেও কবর দিয়েছ।”
জিবরানের আরেক বহুলপঠিত গ্রন্থ নিম্ফ অব দ্যা ভ্যালি। এর গল্পগুলোর মধ্যে এসেছে লেবাননের প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিভিন্ন দৃশ্যাবলি; যাজক ও ক্ষমতাসীনদের অপব্যাখ্যা ও অন্যায় চাপিয়ে দেয়ার শাসন কীভাবে দুর্বলদের গ্রাস করে তার বিবৃতি। এ গ্রন্থের ‘মার্থা’ গল্পটি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। মার্থা এতিম- যে তার মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে শুধু মর্মবেদনার অশ্রু। সে সামান্য খাবার ও মাথাগোঁজার আশ্রয়ের জন্য প্রতিবেশীর দুধেল গাভী চরাতো কারণ মার্থা ছিল দূরবর্তী পাহাড় ও উপত্যকার মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যবতী। একদিন এক ঘোড়সওয়ার তার চাকচিক্য, জমকালো পোশাক ও ভালোবাসার মিথ্যা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে উপত্যকা থেকে তাকে নিয়ে যায়। সে ব্যক্ত করে তার যাতনা, ‘লোকটি সবকিছু করল তার হাসি, মিষ্টিকথা এবং ভালোবাসার মধ্যে এবং সে লুকিয়ে রেখেছিল তার লালসা ও বাস্তব আকাক্সক্ষা। সে তৃপ্ত হওয়ার পর আমার আত্মার দীনতা নিয়ে চলে যায় এবং আমার ভেতরে পরিত্যাগ করেছিল জ¦লন্ত অগ্নিশিখা যা আমার যকৃত বিবর্ণ করে ফেলেছিল এবং তা বেড়ে উঠেছিল দ্রুততার ভেতরে।’ শেষে মেয়েটি নিঃস্ব অবস্থায় একমাত্র পুত্রকে নিয়ে সেখানে বসবাস করত, যেখানে মেয়েরা সস্তায় তাদের শরীর ও আত্মাকে বিকিয়ে দেয়। অল্প কিছু দিন পরে সে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর ভয়াল রাত্রি শেষে- ‘ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্থার শরীর একটা কাঠের কফিনে শোয়ানো হলো এবং দুজন গরিব লোক তা কাঁধে করে বহন করল। একটা মরুভূমির ভেতর তাকে সমাহিত করা হলো, কারণ যাজক তার জন্য প্রার্থনা করবে না, এমনকি তার হাড়গুলিকেও কবরস্থানে বিশ্রামে নিতে দেবে না। ক্রুশচিহ্নটিই শুধু কবরটাকে পাহারা দিচ্ছিল। কোনো শোককারীই এই দূরবর্তী সমাধিক্ষেত্রে যায়নি। শুধু তার ছেলে এবং অন্য একটি ছেলে ছাড়াÑ অস্তিত্বের নিদারুণ দর্দশা যাকে সমবেদনা শিক্ষা দিয়েছিল।’
‘টিয়ারস এন্ড লাফটার’ গ্রন্থে ‘কবির মৃত্যু’ শীর্ষক রচনার মধ্যে আমরা পাই কবি জীবনের এক নিদারুণ চিত্রÑ ‘সে ছিল একজন কবি এবং ধনীদের শহরে যে ক্ষয়ে যাচ্ছিল ক্ষুধার কারণে। মানুষের হৃদয়কে তার সৌন্দর্য ও প্রগাঢ় কথোপকথনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য তাকে জাগতিক পৃথিবীতে স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সে আনন্দের সঙ্গে ঠাণ্ডা পৃথিবীকে বিদায় জানাল বিস্ময়কর দখলকারীর কাছ থেকে কোনো হাসি উপহার পাওয়া ছাড়াই।... কিন্তু হাজার বছর পর অজ্ঞতার রোগ থেকে সুখনিদ্রা ভেঙে জেগে ওঠা লোকেরা সে কবির জন্য স্থাপন করে স্মৃতিসৌধ এবং আয়োজন করে ভোজ উৎসবের, যার রচনা তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল! কী নিষ্ঠুর মানুষের অজ্ঞতা!’
‘স্পিরিটস রেবেলিয়াস’-গ্রন্থে আমরা দেখেছি জিবরানের হৃদয় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে সামাজিক বিভেদ এবং প্রাকৃতিক আসাম্যের বিরুদ্ধে। তার আত্মা ক্রন্দন করে তাদের সঙ্গে, বণিক ও ভূস্বামীরা যাদের বঞ্চিত ও বিতাড়িত করেছে। দরিদ্র বিধবা নারীর স্বরে তার হৃদয় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেÑ ‘সেইসব যাজকদের বিরুদ্ধে যারা খ্রিষ্টের দয়ার্দ্র শিক্ষাকে ধারালো তরবারিতে পরিণত করেছে, যা দিয়ে তারা মানুষের গলা কেটে ফেলে এবং ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দুর্বলের শরীর।’
(তিন)
কহলীল জিবরানের চিত্রকর্মগুলো যেন তার গূঢ় চিন্তা ও ভাষ্যের দৃশ্যায়ন। লেখার মধ্যে যা তিনি স্পষ্ট করতে পারেননি তার বাকি আভাসটুকু যেন চিত্রে প্রস্ফুটিত আবার কোনো কোনো চিত্রের বিবৃতি রয়েছে লেখায়। একেকটি চিত্র যেন অপার রহস্য নিয়ে, অনুদ্ধারনীয় গোপনতা নিয়ে হাজির হয়েছে, সন্ধানী হৃদয় বহুদিন যার অন্বেষে ছিল। তার অঙ্কনের মধ্যে ইংরেজ কবি ও চিত্রকর উইলিয়াম ব্লেকের প্রভাব লক্ষণীয়, ভাস্কর রদ্যাঁ তাকে ‘বিংশ শতাব্দীর উইলিয়াম ব্লেক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন, জিবরানের অঙ্কন শৈলিতে ফরাসি ভাস্কর অগাস্টি রোডিনেরও প্রভাব রয়েছে। জিবরানের চিত্রগুলো যেন আত্মার প্রতিধ্বনি ও সন্তাপকে প্রতীকায়িত করেছে এক নিষ্কলুষ নগ্নতায়, যাবতীয় আচ্ছাদন-আভরণ যেন পৃথিবীর বহুমুখী জাল-জটা যাকে এখানে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। ‘দ্য বার্ডেন’-চিত্রটির দিকে তাকালে মনে হয়, জীবন এক নিরুপায় রমণী অনন্তকাল ধরে যে যাতনাভার বইছে যাকে সে ফেলতেও পারছে না, দুঃখ যেন তার একমাত্র সন্তান। ‘দ্য স্ট্রাগল’ চিত্রটি যেন ঈঙ্গিত করে, ভালোবাসা ও আকাক্সক্ষার প্রতি মানুষের অন্তহীন সংগ্রামশীলতাকে, সে আপ্রাণ চেষ্টাশীল তবু সিদ্ধির সুফল থেকে সে দূরে যদিও ঈশ্বরের আশীর্বাদ তাকে ঘিরে রেখেছে।
কবির চৌধুরীসহ কয়েকজন অনুবাদক জিবরানের দি প্রফেট, বালি ও ফেনা, ব্রোকেন উইংস এবং অন্য দু’একটি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন তবে কবি মোস্তফা মীরের কাজকে অনেকটা অসাধ্য সাধন বলা চলে। তিনি জিবরানের ১৫টি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। আমরা আজ যে কহলীল জিবরান সমগ্র পাঠ করছি, এটা তার দীর্ঘশ্রমের সুকৃতি। এটা বুঝা যায় যে, অত্যন্ত প্রিয় না হলে কেউ কোনো লেখকের এতগুলো গ্রন্থ অনুবাদ করতে পারেন না। আর জিবরানের কবিত্ব এবং অতীন্দ্রিয়বাদী ভাষ্যকে তিনি যেভাবে বাংলায়ন করেছেন, এর মাধ্যমে তার কবিত্ব শক্তি সম্পর্কেও ধারণা করা যায়। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন, সৃষ্টিশীল কাজের পাশাপাশি কহলীল জিবরান অনুবাদের জন্য তার প্রতি দীর্ঘকাল বাংলা ভাষাভাষী লেখক-পাঠকের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জারি থাকবে বলে আমি আশাবাদী।
কহলীল জিবরান একজন অনন্ত-পিপাসু মরমী ও বৌদ্ধিক ব্যক্তিত্ব; জীবনের রহস্য সন্ধানে যারা রত ছিল তাদের মতোই সত্য শ্রবণে উৎকর্ণ ছিল তার কান এবং সৌন্দর্য বীক্ষণে তৎপর ছিল তার চক্ষুদ্বয়। অর্থ, অস্ত্র, প্রভাব ও ঐশ্বর্যের চেয়ে বহুগুণে তিনি ধাবিত হয়েছেন হৃদয়ের মুক্তি ও কল্যাণের অভিমুখে। সৃষ্টিশীল রচনার মধ্যে যে বিষয় স্পষ্ট হয়নি তা খোলাখুলিভাবে ওঠে এসেছে, ‘তোমার এবং আমার চিন্তা’ শীর্ষক একটি অণু-রচনায়। ‘তোমার চিন্তা জাতির গৌরবকে ধরে রাখে তার বীরদের ভেতরে। এটা গায় প্রশংসাগীত রামেসিস, আলেকজান্ডার, সিজার, হানিবল এবং নেপোলিয়নের; কিন্তু আমার চিন্তা দাবি করে কনফুসিয়াস, লাওৎসি, সক্রেটিস, প্লেটো, আবু তালেব, আল গাজ্জালি, জালালউদ্দিন রুমি, কোপারনিবাস এবং লুই পাস্তুরের মতো প্রকৃত বীরদের।’
কহলীল জীবরানের বিশেষত্ব হচ্ছে কেবল তার প্রতিটি পুস্তক নয় অনেক রচনার প্রতিটি বাক্যই শক্তিশালী, তাৎপর্যপূর্ণ এবং বিশদ ব্যাখ্যার দাবিদার। জীবনের গভীরগোপন অনেক আলাপ, অনেক রহস্য ও সত্যাসত্যে পূর্ণ তার রচনাবলি। সাহিত্যকর্ম বিশেষত কবিতা ভাষান্তরের ফলে মূল থেকে অনেক দূর সরে যায়, তার ভাষিক ব্যঞ্জনা ক্ষয়ে যায় তবে জিবরানের অনুবাদ পাঠেও যা কিছু এসেছে তাও মহার্ঘ, তাও যেন পবিত্র স্তোত্রের মতো মনোময়। লেবানিজ শিল্পী ফাইরুজ জিবরানের প্রফেট এবং গিভ মি দ্য ফ্লত-কে ভেঙে সুর-চারিয়ে কণ্ঠে তুলেছেন, সেখানেও সাধারণ সাংগীতিকতা ছাড়িয়ে গানগুলো যেনো অভিনব ঐশ্বরিক মূর্ছনা ব্যক্ত করেছে। জিবরানকে নিয়ে আসলে লিখে শেষ করা যাবে না। অনেক অনুভূতিকে ভাষা দিতে যেমন আমরা অপারগ কিংবা ভাষার সীমাবদ্ধ রয়েছে অনেক অনুভূতি প্রকাশে, জিবরান ঠিক তেমনি অনুভবের অনুবাদক। তাকে পাঠ করা প্রয়োজন, প্রয়োজন অনুভবের যদি হৃদয়ের গোপনীয়তাকে উদ্ধারের জিজ্ঞাসা সামনে আসে।
সৌম্য সালেক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে