দ্বিতীয় পর্ব
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছেন
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। একাধারে তিনি ইতিহাসবেত্তা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করেছেন- তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক লেখক, যিনি ১৯৭৩-এর নির্বাচন নিয়ে লিখেছেন ‘তিয়াত্তরের নির্বাচন’ নামে একটি বই। লিখেছেন ‘লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’, ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’, ‘আওয়ামী লীগ বিএনপি কোন পথে’, ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ ইত্যাদি গ্রন্থ। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে এখনো লিখে চলেছেন।
সম্প্রতি ভিউজ বাংলাদেশ-এর ‘এডিটরিয়াল ডায়ালগ উইথ রাশেদ মেহেদী’ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আলোকপাত করেছেন দেশের রাজনীতির উত্থান-পতন নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশ-এর সম্পাদক রাশেদ মেহেদী। চার পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব:
রাশেদ মেহেদী: এখানে যদি একটু কথা বলি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন এলো, জাসদও কোমায় চলে গেছে। এরপর বিএনপির রাজনীতির উত্থান। বিশেষ করে মুসলিম লীগের সাবেক নেতারা ন্যাপ-ভাসানী ও কিছু বামপন্থি মিলে বিএনপি হলো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি অনেকটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এবং প্রধান রাজনৈতিক দলও বটে- এই রাজনীতিটাকে কীভাবে দেখছেন? জিয়াউর রহমানের যে রেজিমটা ছিল, সেখানে আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা বা গুণগত পরিবর্তন কিংবা যেটা পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল- সেটা হয়েছে? সে জায়গাটা আসলে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মহিউদ্দিন আহমদ: ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট একটা শূন্যতা তৈরি হলো। একটা প্রবল প্রতাপশালী, যিনি দেশ পরিচালনা করছেন, হঠাৎ করে তিনি আর নাই। একটা বিরাট শূন্যতা কিন্তু। তো ওই সময় আমরা দেখলাম সেনাশাসন। বাংলাদেশের ভেতরে সবচেয়ে সংঘটিত রাজনৈতিক শক্তি হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী। আমার জানামতে, এটাই একমাত্র পেশা যেখানে ট্রেনিং নেওয়ার পর চাকরি হয়। আর সবজায়গায় চাকরি পাওয়ার পর ট্রেনিং হয়। যা হোক সশস্ত্র বাহিনী সবচেয়ে সংঘটিত। সই হিসাবে ওই শূন্যতাটা সেনাবাহিনী পূরণ করেছে। ওই সময়ের সবচেয়ে অর্গানাইজড সোশ্যাল ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী দৃশ্যপটে এলো এবং তার শূন্যতা পূরণ করল। কমন স্ট্রাকচারে সেখানে জিয়াউর রহমানের হাতেই কর্তৃত্ব। যদিও নামকাওয়াস্তে একটি সিভিলিয়ান ছিল বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন; কিন্তু কার্যত সামরিক শাসন থাকলে সেনাবাহিনীর প্রধানই হচ্ছে প্রধান সেনাশাসক। তারপর তিনি রাজনীতিতে গেলেন।
আমার এখনো মনে আছে, ১৯৭৬ সালের ১ মে। মে দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশে সেনাবাহিনীর মধ্যে খাকি পোশাকের বদলে কমরেড ড্রেস ফুলহাতা শার্ট সেগুলো জিয়াউর রহমান পরলেন। ছবিটা এখনো দেখা যায়। তখন তিনি বলছিলেন যে, আমি একজন সৈনিক। আমি রাজনীতি বুঝি না- এ ধরনের একটা কথা। তারপর তিনি আস্তে আস্তে রাজনীতিতে আসলেন। নিজে একটা দল করলেন, মডেলটা কিন্তু আইয়ুব খানের। প্রথমে ক্ষমতায় গেলেন। জিয়াউর রহমান প্রথমে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তারপর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেন, তারপর সায়েমকে সরিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি হলেন। তারপর তিনি একটা হ্যাঁ-না ভোট রেফারেন্ডম করলেন। তার মধ্যে একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করলেন। সেখানে দেখা গেল, যে পরিমাণ ভোট দেখানো হলো এটা খুব লজ্জাজনক।
সরকারি কর্মকর্তাদের বলে দেয়া হয়েছিল যে তোমরা হ্যাঁ ভোট দিবে। কারণ রেফারেন্ডমে ভোটাররা যায় না। হার জিতের ব্যাপার নাই তো। হয়তো ৫-১০ পার্সেন্ট লোক যায়। সেটা ৯৫/৯৭/৯৮ পার্সেন্ট দেখানো হয়েছে। একেবারে আইয়ুব মডেলে তিনি রাষ্ট্রপতি হলেন। তারপর তিনি ৬টা দলকে নিয়ে একটা পলিটিক্যাল ফ্রন্ট করলেন। মুসলিম লীগ ভাঙল, শাহ আজিজের নেতৃত্বে একটা গ্রুপ এসে এই ফ্রন্টে ঢুকল। মশিউর রহমানের নেতৃত্বে ভাসানী-ন্যাপ এ ফ্রন্টে ঢুকল। তারপর লেবার পার্টি, তপশিলি ফেডারেশন এরকম ছোটখাটো এরাও যুক্ত হলো। মূল ছিল ভাসানী-ন্যাপ। তারপর ওই ফ্রন্টে প্রতিনিধি হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ইলেকশন করলেন। আর তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা জোট ছিল।
আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ সবাই মিলে ওই ফ্রন্টের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করলেন এম এ জি ওসমানী। সেই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জিতলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি হলেন। তার একটা ম্যান্ডেট দরকার ছিল কারণ মিলিটারি ডিক্টেটার জোর করে ক্ষমতা নিয়েছে বাইরের দুনিয়া এটা খুব পছন্দ করে না। ভালো চোখে দেখে না। তার পেছনে যে জনগণের ম্যান্ডেটটা সেটা নিয়ে নিলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি ফ্রন্ট আর রাখবেন না। তার পেট্রোনাইজে নতুন একটা দল হয়েছিল ‘জাগো দল’। সেখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার ছিলেন। এটাও ওই ফ্রন্টের মধ্যে ছিল। জিয়াউর রহমান করলেন কী- ফ্রন্ট এবলিস (বিলুপ্ত) হয়ে যাবে। তখন তিনি বিএনপি তৈরি করলেন ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ঢাকার রমনা রেস্টুরেন্টে একটা সংবাদ সম্মেলন করে নাম ঘোষণা করে দিলেন ১০১ সদস্যের একটা কমিটি নিয়ে। তিনি এটার চেয়ারপারসন। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রন্ট বিলুপ্ত হয়ে গেল। এতে ফ্রন্টের অনেকেই বিএনপিতে যোগ দেননি। আমার মনে আছে, কাজী জাফর তিনি ফ্রন্টে ছিলেন বিএনপিতে যোগ দেননি, এরকম কয়েকজন বাকিরা তো গেলই। তো একজন সামরিক কমান্ডার এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে তার যে রূপান্তর এটা আমরা এভাবে দেখি।
একই মডেলটা পরবর্তীতে দেখা গেল। এরশাদকে দেখা গেল একই মডেলে। এরশাদ শুধু হ্যাঁ-না ভোটটা করেননি; কিন্তু ওই যে একটা দল করলেন। তারপর ১৮ দফা। তারপর এরশাদ জাতীয় পার্টি করলেন। তিনি প্রধান হলেন না, কারণ তখনো তিনি একটিভ মিলিটারি সার্ভিসে। যখন তিনি অবসরে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে পার্টির চেয়ারম্যান। তার আগে তিনি যে কাজটা করলেন- একটা ইলেকশন করিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিনি নিয়ে নিলেন ১৯৮৬-এর পার্লামেন্ট ইলেকশনে। তার দুই-তিন মাস পর রাষ্ট্রপতির নির্বাচন আরেকটা করালেন। সেটা নিয়ে খুব বিতর্ক উঠছিল। কয়েকদিন পরই রাষ্ট্রপতির নির্বাচন। পার্লামেন্ট ইলেকশন জুন-আগস্টে হলো। হওয়ার পর ওইদিন তিনি ‘মার্শাল ল’ উইথড্র করলেন। ৮৬-এর পার্লামেন্ট ৮৭-তে গিয়ে তিনি এবলিস করে দিলেন। পরে ১৯৮৮-তে আরেকটা পার্লামেন্ট নির্বাচন করলেন যেখানে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো বর্জন করেছিলে যেখানে আ স ম আবদুর রব বিরোধী দলের নেতা। তখন এ কথাটা চালু হয়ে গেল যে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’।
রাশেদ মেহেদী: তারপর?
মহিউদ্দিন আহমদ: ১৯৮৬ সালে যখন পার্লামেন্ট ইলেকশন হয় তখন সবাই একমত ছিলেন যে নির্বাচনটা বর্জন করবেন। তখন তাদের দাবি ছিল, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। এরশাদের পদত্যাগ চেয়ে দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছিল সেটা ১৯৮২ থেকে শুরু করে। ওই সময় আমরা দেখলাম, ১৫-দলীয় জোট, চার-দলীয় জোট হলো। শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া একেবারে আন্দোলনের সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিলেন। সবার মধ্যে সমঝোতা যে, আমরা এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না। চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দানে শেখ হাসিনা একটা বক্তৃতা দিলেন যে, যারা এ নির্বাচনে যাবে তারা হবে জাতীয় বেইমান। পরের দিন তিনি ঢাকায় ফিরে ঘোষণা দিলেন তিনি নির্বাচনে যাবেন। ওই অবস্থায় বিএনপি খুবই অপ্রস্তুত ছিল। নির্বাচন করার মতো সক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে। ওখান থেকে খালেদা জিয়াকে ‘আপসহীন নেত্রী’ বলা হচ্ছে; কিন্তু শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ায় সমালোচনা হলো- এরশাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করেছিল। বোঝাপড়া ছিল এটা যেহেতু রাষ্ট্রপতি শাসিত তখন। এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকবে, পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ মেজরিটি হবে। হওয়ারই কথা। কারণ বিএনপি নাই, জাতীয় পার্টি নতুন, এটার কোনো জনভিত্তি নাই। ওভারঅল মেজরিটি নিয়ে আওয়ামী লীগ চলে যাবে- এটা সবারই ধারণা। হাসিনাও ভেবেছিল। এরশাদ হয়তো তাকে কথা দিয়েছিল যে, ভালো একটা ফেয়ার ইলেকশন হবে। এটা হলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন। পাওয়ার পলিটিক্সের পার্ট হবে শেখ হাসিনা। এরশাদ প্রেসিডেন্ট, হাসিনা প্রধানমন্ত্রী।
তো নির্বাচনের ফলাফল যখন ঘোষণা হয়, আপনার হয়তো খেয়াল আছে ‘মিডিয়া ক্যু’ শব্দটা ওই সময় থেকে চলে এসেছে। অর্থাৎ মিডিয়াতে আসছে যে, একজনের পর একজন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতছে। তারপর ৬৮ ঘণ্টা নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণা বন্ধ ছিল। তখন এরপর থেকে ‘মিডিয়া ক্যু’ শব্দটা এলো। দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল- ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মিডিয়া ক্যু’। এরকম একটা কিছু। তারপর আমরা দেখলাম, জাতীয় পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, আমার ওই সময়ের বন্ধুবান্ধব উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওরাই কিন্তু বলেছে কীভাবে ম্যানিপুলেশন (কারসাজি) হয়েছে। (চলবে)
শ্রুতিলিখন: শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে