Views Bangladesh Logo

জেলহত্যাকান্ড এখনও তাড়া করে বেড়ায়

Mohiuddin  Ahmad

মহিউদ্দিন আহমদএর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ধোঁয়াশাপূর্ণ এক অধ্যায় ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস। ইতিহাসের এই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে পরস্পর বিরোধী দাবি আর দোষারোপের শেষ নেই। ৪৮ বছর পরও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতো করে দিনটিকে পালন করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ছিল খুবই জটিল। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর হতো বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের নির্দেশে। সে সময়ের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা যা মানতে পারছিলেন না। এমনই এক প্রেক্ষাপটে জাতীয় জীবনে আসে ৩ নভেম্বর। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এক অভ্যুত্থানের সূচনা করেন মোশতাক-খুনি চক্রের বিরুদ্ধে; কিন্তু সেই চেষ্টা সমন্বিত ছিল না। ছিল না কোনো সুর্নিদিষ্ট পরিকল্পনা।

ইতিহাসের এই অধ্যায় নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষে লেখক, রাজনৈতিক ইতিহাসগবেষক মহিউদ্দিন আহমদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ।

-
রাহাত মিনহাজ: ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এর অভ্যুত্থানের সূত্রপাত কীভাবে হলো। এর প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি হয়েছিল?  

মহিউদ্দিন আহমদ: ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কিন্তু ১৫ আগস্টের সেই কালো রাতের প্রসঙ্গ চলে আসবে। যেদিন আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছিলাম।  ১৫ আগস্ট না হলে ৩ নভেম্বর হতো কি না অথবা একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান, সেটি কার নেতৃত্বে কখন হতো, এটা নিয়ে আলাদা গবেষণা হতে পারে।

আমরা অনেক সময় ইতিহাসের খুব সরল ব্যাখ্যায় চলে যাই। ইতিহাসের কতগুলো জোরালো বয়ান থাকে, বিভিন্ন সময় যারা ক্ষমতায় থাকেন বা গণমাধ্যমের কর্তৃত্ব করেন, তারা এক ধরনের বয়ান দিয়ে একটা ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। আমরা যদি খুব বেশি অনুসন্ধান করি, যদিও সেই অনুসন্ধানের অবকাঠামোগত কিংবা রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশ নিয়ে ভাবি- তাহলে দেখবো সবসময় তেমন পরিবেশ থাকে না। তবুও বলব, যদি আমরা সেনা মনস্তত্ত্ব বিচার করি, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরে শুরু থেকেই একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সেটা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। আরেকটা ছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন কমান্ডারদের দ্বন্দ্ব, যার প্রকাশ আমরা দেখি ১৯৭৫ এবং এর পরবর্তী সময়ে।

১৫ আগস্ট যে হত্যাকাণ্ডটি সংঘঠিত হলো, সেটি একটি গ্রুপ করল; কিন্তু পুরো সেনা নেতৃত্ব সেটাকে অনুমোদন করল। পরে ৩ নভেম্বর যে অভ্যুত্থানটা হলো, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভ্যুত্থানকারীরা দুটো জিনিস বলেছিল, প্রথমত: সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড রিস্টোরকরা। বঙ্গভবনে বসে যে মেজর-ক্যাপ্টেনরা ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে এনে কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা। পরবর্তীতে রাজনৈতিক আনুকূল্য পাওয়ার জন্যই হোক অথবা সুবিধা পাওয়ার জন্যই হোক তারা বলেছে, তারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ৩ নভেম্বর ঘটিয়েছেন। যদিও সেটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

 রাহাত মিনহাজ: এই অভ্যুত্থানটি কীভাবে সংঘটিত হলো? 

মহিউদ্দিন আহমদ: ২ নভেম্বর রাতে অভ্যুত্থানটি হয়। বঙ্গভবনের পাহারায় যে দুই কোম্পানি সৈন্য ছিল, তারা সবাই ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের সৈন্য। এরা ছিলেন শাফায়েত জামিলের কমান্ডে। অর্থাৎ বঙ্গভবন পাহারায় ছিলেন শাফায়েত জামিলের অনুগত লোকেরাই প্রায় আড়াই মাস বা ৮০ দিনজুড়ে। ওই রাতে তারা বঙ্গভবন অরক্ষিত রেখেই চলে আসে। এটাই হলো অভ্যুত্থান। তারপরে ভোরবেলায় বিমান উড়ল। ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের সেই কুশীলবরা বিমান বাহিনীকে যুক্ত করেনি, এতে বিমান বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা নাখোশ ছিলেন। তাদের কথা ছিল, ১৫ আগস্টে তোমরা এত বড় একটা অ্যাডভেঞ্চার করে ফেললে আমাদের বাদ দিয়ে। তাই ৩ নভেম্বরের ঘটনায় তারাও জড়িত হয়ে গেলেন।

রাহাত মিনহাজ: এই অভ্যুত্থানের প্রথম দিকে কী কী ঘটনা ঘটল। কী ধরনের পরিবর্তন এলো রাষ্ট্র কাঠামোয়, একটু বিস্তারিত জানতে চাই? 

মহিউদ্দিন আহমদ: যখন ৩ নভেম্বর ভোরে এই অভ্যুত্থানটি ঘটে গেলো, ওই সময় জেলখানায় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। জেলখানায় আমাদের যে জাতীয় চার নেতা আছেন, তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো।  ১৫ আগস্টের পর থেকে সেনাবাহিনীর ভেতের যে বিশৃঙ্খলা চলছিল, তা আরও চরম আকার ধারন করল। চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াকেও অন্তরীণ করলেন ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা। তার কাছ থেকে একটা পদত্যাগ পত্র আদায় করলেন। দ্বিতীয়ত তারা একটি কাণ্ড করলেন, তারা খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বহাল রেখে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করার জন্য লবিং করতে শুরু করলেন। ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের যারা কুশীলব ছিলেন তাদেরকে নিরাপদে দেশত্যাগ করার সুযোগ করে দিলেন। কারণ যখন একটা পালাবদল হচ্ছে, তখন ১৫ আগস্টের কুশীলবরা দেখলেন, তারা ক্ষমতাহীন অবস্থায় দেশে থাকতে চান না। তারা চলে গেলেন। আলাপ-আলোচনা কিন্তু করেছিলেন সবাই মিলে। রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা এম.এ.জি. ওসমানী এবং চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান সবাই মিলে। ১৫ আগস্টের কুশীলবরা সপরিবারে ব্যাংককে চলে যায় সেদিনই রাতের বেলা।

রাহাত মিনহাজ: ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের ভেতরেই জেল হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। জেলখানার সুরক্ষিত স্থানে তাদের হত্যা করা হলো। অভ্যুত্থানকারীরা দাবি করেন, তারা এই বিষয়টি পরে জানতে পারেন। আসলে রহস্যটা কী। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভেতর-বাইরে ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছিল?

মহিউদ্দিন আহমদ: শাফায়েত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী ৪ নভেম্বর তারা জানতে পারলেন জেলখানায় চারজন নিহত হয়েছেন। এটা খুবই আশ্চর্য লাগে। কারণ ৩ নভেম্বর প্রাক্কালে, অর্থাৎ রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে অভ্যুত্থানটি হল। ওই সময়েই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হলো। এটা কেউ টের পেলেন না, কেউ জানলেন না! জেলখানায় কিন্তু কেউ ট্যাংক কামান নিয়ে যায়নি। কয়েকজন গেছেন, স্টেনগান, রাইফেল- এসব অস্ত্র নিয়ে। জেলের গেট খুলে না দিলে এরা কোনো অবস্থাতেই ঢুকতে পারতো না। গোলাগুলি হতো। জনগণ জেগে উঠত। অনেকেই চলে আসত। তাই এটা সম্ভব ছিল না। যে গল্পটি আমরা জানি, খন্দকার মোশতাক টেলিফোন করলেন। তার নির্দেশ শুনে জেল গেট খুলে দেওয়া হলো। তারা কয়েকজন ভেতরে গিয়ে চারজনকে মেরে চলে আসেন। এই বয়ানটি আমরা বছরের পর বছর শুনছি। আমরা কেউ প্রশ্ন করি না, তোমরা জেল গেটটা খুললে কেন? ওরা কি ট্যাংক নিয়ে এসেছিলো? তারা তো ট্যাংক নিয়ে আসেনি। এটা হলো একটা ব্যাপার। দ্বিতীয় ব্যাপারটি হলো চার তারিখ সকাল পর্যন্ত তিন তারিখের অভ্যুত্থানকারীরা জানতে পারলো না যে জেলখানায় এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে?

তাদের দাবি অনুযায়ী তাদের মনের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র একটা ইচ্ছা থাকতো যে তারা ১৫ আগস্টের বদলা নিচ্ছেন এবং ১৫ আগস্টের পরবর্তী অবস্থান যেটা, সেটার পরিবর্তে আবার একটা রাজনৈতিক সরকারে ফিরে যাওয়া, সেটাই তাদের পরিকল্পনায় থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই তারা তাদের প্ল্যানের মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে রাখতেন, তাদের খুন করতেন না। তারা তো তাদের পরিকল্পনার মধ্যেই চার নেতাকে রাখেননি। তারা খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি রেখেই খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করতে চেয়েছিলেন। অভ্যুত্থানকারীরা সত্যিই ১৫ আগস্টের বদলা নিতে চাইলে প্রথমেই খন্দকার মোশতাককে গ্রেফতার করতেন। তার সাঙ্গপাঙ্গদের গ্রেফতার করতেন। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বসিয়ে দিতেন।

তারা সেটা করেননি। বরং ৪ নভেম্বর যখন তারা খবর পেলেন বলে দাবি করছেন, যে এই চার নেতা জীবিত নেই। তারা তখন কী করতে পারতেন? একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হলে কী করতে হতো? আমাদের সংবিধানে যা আছে, রাষ্ট্রপতি এবং উপ-রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার হবেন রাষ্ট্রপতি। স্পিকার আবদুল মালেক উকিল তো তখন ছিলেন; কিন্তু তারা কী বললেন? খন্দকার মোশতাক যখন কোনোভাবেই খালেদ মোশাররফের শর্তে রাজি হচ্ছিলেন না, শেষমেশ তাকে দিয়ে একটা পদত্যাগ পত্র সই করানো হলো। প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হলো। মালেক উকিলকে নয়। তার মানে সংবিধানের ধারে কাছেও তারা গেলেন না। দ্বিতীয়ত, তারা আরেকটা কাণ্ড করলেন। তখন পার্লামেন্ট ছিল নামকাওয়াস্তে। এই পার্লামেন্টকে খালেদ মোশাররফ ৬ নভেম্বর তারিখে সায়েমকে দিয়ে বাতিল করে দিলেন। এর আগে কিন্তু পার্লামেন্ট বাতিল হয়নি। এমপিরা বঙ্গভবনে গিয়ে মিটিং করতেন। পার্লামেন্টটি বাতিল হয় একটা অর্ডিন্যান্সে, সাইনড বাই সায়েম অন ৬ নভেম্বর। এর আগে পার্লামেন্টের মেম্বাররা যেতেন। সকালে মিটিং করতেন। মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক হতো বঙ্গভবনে। এবার পার্লামেন্ট বাতিল হলো। সায়েমকে তারা ঘোষণা করলেন চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। যেটা খন্দকার মোশতাক ছিলেন।

রাহাত মিনহাজ: ১৫ আগস্ট যেমন রক্তপাত হয়েছে সেই বিবেচনায় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে কোনো রক্তপাত হয়নি। বলা যায়, রক্তপাতহীন এক প্রচেষ্টা। যদিও এই অভ্যুত্থান পরিচালনাকারীরা খুব কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারেনি। মানে তারা যেমন রক্তপাত ঘটাননি আবার তেমনি সফলও হতে পারেননি। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 

 মহিউদ্দিন আহমদ: আপনার প্রথম প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি। এই অভ্যুত্থানটি রক্তপাতহীন হলো কেন? আমাদের যে পলিটিক্যাল লিগ্যাসি আমরা যদি ১৯৪৭ থেকে শুরু করি, আমরা ১৯৭৫ এর আগে দুটো সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেছি। একটা আইয়ুব খানের, আরেকটা ইয়াহিয়া খানের। দুটো অভ্যুত্থানই রক্তপাতহীন। সুতরাং সামরিক অভ্যুত্থান হলেই বা সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলেই যে রক্তপাত হবে, এটা আমি মনে করি না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে আমরা ভয়াবহ, নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখলাম। এটা বলা যায় যে Targeted against one greater family. বঙ্গবন্ধু, তার ভগ্নিপতি এবং ভাগ্নে এই তিনটা বাড়িতে হামলা হলেছিল। সেদিন ১৫ আগস্টে তারা চাইলে কেবলমাত্র এই চার নেতা কেন, এমন আরও ৪০ নেতাকে হত্যা করতে পারতো। অবশ্যই পারতো। কোনো প্রতিবাদ তো আমরা দেখিনি। সেটা তারা করেনি। এখন কথা হচ্ছে ৩ নভেম্বর যারা অভ্যুত্থান করল, তাদের কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। ১৫ আগস্টের কিন্তু একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। ৩ নভেম্বরে সে রকম কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। এটা ছিল পুরোপুরি সেনাকর্তৃত্ব। সেনাবাহিনীর একটা গ্রুপ সেখানে মাস্তানি করছে। তাদের খপ্পর থেকে এটা তারা উদ্ধার করে পুরো কর্তৃত্বটা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসবে। মূলত এটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সেখানে তারা কাকে মারবে? মারলে তো মারতে হতো খন্দকার মোশতাককে। তারা তো খন্দকার মোশতাককে বহালই রাখতে চেয়েছে।

 রাহাত মিনহাজ: অনেকেই বলে থাকেন এটি ছিল ভারতপন্থি একটি অভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য। এই মূল্যায়ন কতটা যৌক্তিক? 

মহিউদ্দিন আহমদ: এই অভ্যুত্থান ভারতের পক্ষের ছিল কী না- এটা কিন্তু আজকে আমরা ৪০-৫০ বছর পরে এসে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। পাকিস্তান আমলেও এদেশের মানুষ ভারত বিরোধী ছিল। ষাটের দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারত প্রেম হয়নি, কেবলমাত্র পাকিস্তান বিরোধিতা এসেছে এবং পাকিস্তানের সাথে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরে পাকিস্তান আর দৃশ্যপটে নেই। তখন আবার ভারত সামনে চলে এসেছে। ভারতের সাথে এখানকার মানুষের যে দ্বন্দ্বটা, এটার পিছনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও ঐতিহাসিক নানান কারণ আছে। এটা তিন-চার বছরে মীমাংসিত হওয়ার কথাও নয়।

অন্যদিকে বাকশাল সরকার বা আওয়ামী সরকারকে ভারতপন্থি সরকার হিসেবে দেখা হতো। এটা সবার জানা কথা। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি আর ভারত বিরোধী রাজনীতি একাকার হয়ে গিয়েছিল। এখন ৩ নভেম্বর একটা অভ্যুত্থান হলো এবং এটা যখন জিয়া-মোশতাকের বিরুদ্ধে গেলো, জনমনে একটা perception develop হতেই পারে এটা ভারতের পক্ষের অভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগের পক্ষের অভ্যুত্থান। ৪ নভেম্বর তারা একটা বিশাল মিছিল বের করলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আসলো বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে। এটার মূল আয়োজক ছিল সি.পি.বি.। তখন সি.পি.বি, ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্রলীগ একসাথে মিলে বাকশালের জাতীয় ছাত্রলীগ নামে সংগঠন ছিল। সি.পি.বি. ছাত্রলীগের কাঁধে বন্দুক রেখে এই কাজটা করলো। কলাবাগানের সামনে যখন মিছিলটা আসলো, তখন খালেদ মোশাররফের ভাই রাশেদ মোশাররফ এবং তার মা মিছিলে যুক্ত হলেন। সুতরাং মানুষ দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে দেখল, এটা তো আওয়ামী লীগের পক্ষের অভ্যুত্থান। অতএব এটা ভারতপন্থী অভ্যুত্থান। সাথে সাথেই কিন্তু  মানুষ ধরেই নিলো, খালেদ মোশাররফ হচ্ছেন ভারতের দালাল। ওই সময়ে খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করার জন্য সেনাবাহিনীতে যে লিফলেটিং হয়েছে, খালেদ মোশাররফ ভারতের চর, ওই সময় এটা সবাই তখন গ্রহণ করেছে। কারণ ওই সময় ওই মিছিলটা করতে দেওয়া এবং ওই মিছিলটা যে উদ্দেশ্যে হয়েছিল, ওটা করে কিন্তু ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটাকে একটা পার্টির রূপ দিয়ে দেয়।

তবে খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের পক্ষে বা আওয়ামী লীগকে সরকারে বসানোর জন্য অভ্যুত্থান করেছে, এটা আমি মনে করি না। করলে তো তারা জেল হত্যাকাণ্ডটা হতে দিতো না। জেলখানাটাকে আগে নিরাপদ করে তারপরে অভ্যুত্থানটা ঘটাতো। একটা সেন্সেবল কমান্ডার হিসেবে এটাই হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। আমি কমান্ডার ছিলাম না। আমি সিভিলিয়ান। কিন্তু আমার কমনসেন্স বলে যে এটা করেনি, সে কমান্ডার হওয়ার যোগ্যই না। শাফায়েত জামিলরা ৩ নভেম্বর নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের রূপকল্পনার মধ্যেই এটা ছিল না। তাদের চিন্তাতেই ছিল না, একটা পলিটিক্যাল রেজিম আসবে তাদের অভ্যুত্থানের ফলে। তারা এটা চাননি।

জেলের ভেতরে জাতীয় চার নেতা হত্যাকোন্ডের ঘটনা এখনও আমাদের তাড়া করে  বেড়ায়। এর পেছনে সত্যিকারের কি কারণ ছিল তা নিয়ে এখনও অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

 

রাহাত মিনহাজ: আপনাকে ধন্যবাদ।

মহিউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ