শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্যে ঢাকাকে ব্র্যান্ডিং করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে
গত চার দশক ধরে বাংলা কবিতা দিয়ে পাঠকদের মুগ্ধ করে রেখেছেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। তার কবিতায় প্রেম, প্রতিবাদ, মানবিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন দুর্দান্ত শৈলীতে উঠে এসেছে। রেজাউদ্দিন স্টালিনের জন্ম ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর, ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলভাঙ্গা গ্রামে। তার রচিত কবিতার বইগুলোর মধ্যে ‘ভালোবাসা তুমি,’ ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ এবং ‘আমি তুমি সে’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। শিল্পকলা একাডেমির কর্মপরিধি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও স্বপ্ন নিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ভিউজ বাংলাদেশের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের এডিটরিয়াল অ্যাসিসট্যান্ট শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
ভিউজ বাংলাদেশ: শিল্পকলার একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে আপনার নতুন পরিকল্পনা কী? নতুন করে কীভাবে সাজাচ্ছেন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: শিল্পকলা একাডেমিতে এতদিন যেসব কর্মসূচি অকার্যকর ছিল এবং দলীয়করণের কারণে যেসব কর্মসূচি সঠিকভাবে সামনে এগোতে পারেনি, এসব কর্মসূচিকে ঢেলে সাজাচ্ছি। তার মধ্যে রয়েছে আমাদের সংগীত উৎসব, নৃত্য উৎসব, চিত্রকলা উৎসব, এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল এসব ঢেলে সাজাচ্ছি। তারপরে আমাদের প্রতিটি বিভাগে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগ্য, নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে তাদের দায়িত্ব দিচ্ছি। প্রশিক্ষণগুলোকে আরও ঢেলে সাজাচ্ছি।
এ ছাড়াও ঢাকার বাইরে শিল্পকলা একাডেমির অধীন যেসব শাখা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোকে আরও কার্যকর করছি। আমি বিশেষ করে একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, সেখানে শিল্পকলা একাডেমির বুক সেলফ সেন্টার করব। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট এদেরও কিছু কিছু প্রকাশনা আমরা রাখব, যেন এখানে মানুষ আসে এবং বই কেনে। কারণ বই কেনাবেচা-পাঠাভ্যাস এখন কমে গেছে। সেটাকে বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং শিল্পকলার যেসব ইতিবৃত্ত আছে, গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ আছে সেগুলোকে আমরা মানুষের হাতে পৌঁছে দিতে চাই। লাভ করব না, খুব অল্প মূল্যেই আমরা বইগুলো মানুষকে দিতে চাই।
আরেকটি হচ্ছে, আমরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের ঢাকাকে ব্র্যান্ডিং করব। আমাদের পরিচালকরা খুবই যোগ্য এবং তারা কেউ ব্র্যান্ডিং বিষয়ে, কেউ গবেষণা বিষয়ে, কেউ নাট্যকলা, কেউ সংগীত বিষয়ে খুব পারদর্শী, তারা কাজগুলো করছেন। আমরা ঢাকাকে পৃথিবীর সংস্কৃতিতে ব্র্যান্ডিং করব। যেমন চিত্রকলার বড় স্বর্গরাজ্য ফ্রান্স, ফ্রান্সকে ব্র্যান্ডিং করা হয় আইফেল টাওয়ার দিয়ে। লন্ডনকে যেভাবে তার সংস্কৃতি দিয়ে ব্র্যান্ডিং করা হয় ........আমরা এরকমই ঢাকাকে ব্র্যান্ডিং করব। এটা আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় হবে।
আর আমাদের দেশীয় যে সংস্কৃতি, লোকসংগীত যেটাকে লোকসংগীত বলে শহরের মানুষ নাক সিঁটকায়, অথচ এটা বাংলার প্রকৃত গান। এখানে মানুষের দুঃখ বেদনা হাহাকার আনন্দের গান থাকে, সেই লোকগানগুলোকে নগরায়ণ করে সামনে আনা। আর আমাদের যারা প্রাজ্ঞজন আছেন, আমাদের যারা গুরুত্বপূর্ণ কবি সাহিত্যিক শিল্পী সংগীতশিল্পী তাদের আমরা সম্মানিত করব। যারা প্রয়াত যেমন কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ- তাদের আমরা স্মরণ করব। জীবনানন্দ দাশকে আমরা একটু অন্যভাবে উপস্থাপনের চিন্তা করছি। আমার সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, শিল্পকলাকে ঢেলে সাজানো।
ভিউজ বাংলাদেশ: এর আগে যিনি মহাপরিচালক ছিলেন, তিনি অনেক অনিয়মের অভিযোগ করলেন। সে জায়গায় আপনার অবস্থান কী?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: আমি সেই অনিয়মগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি এবং সেগুলো থেকে শিল্পকলা একাডেমিকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি। মুক্ত প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করছি। একজন কবি, একজন লেখক হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে একটি ভালোবাসার জগৎ তৈরি করা, শিল্পের জগৎ তৈরি করা, যেখানে সব স্টেক হোল্ডার সমান অধিকার সমান সুযোগ পাবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আগের মহাপরিচালক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি দূরত্বের কথা বলেছিলেন, সেটা এখন কেমন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: না, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। তারা সবসময় আমাদের খুব সহযোগিতা করছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এখন যোগ্য সচিব এবং মাননীয় উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সাহেব, তিনি আমাদের খুব সহযোগিতা করছেন। তিনি খুব ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা করছেন-কীভাবে শিল্পকলাকে আরও বেশি করে অগ্রসর করা যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: সংস্কৃতি নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী? ইদানীং ‘বাবু সংস্কৃতি’ নামে এরকম একটি কথা উঠেছে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন: আমাদের এখানে কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যারা আছেন, তারা চেষ্টা করেন এটা বুঝানোর যা কিছু ভালো সবই কলকাতার। আমাদের দেশের কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের এড়িয়ে যায় তারা। যেরকম আমাদের দেশে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এরা অনেক বড় কবি। এদের কথা আমরা সেভাবে সামনে আনছি না। কলকাতার কোনো একজন কবি বাংলাদেশে এলে তাকে নিয়ে আমরা খুব মাতামাতি করছি। আমাদের দেশের কোনো কবি-শিল্পীকে ওভাবে মূল্যায়ন করি না। কম করি।
হ্যাঁ, এটাও ঠিক কলকাতাও বাংলা ভাষার অংশ, সে হিসাবে আমরা তাদের সম্মান করি। তাদের সঙ্গে আমাদের খুবই ভালো সম্পর্ক। কিন্তু আমরা আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে আগে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সেই কালচারটাকে যেন আমরা গড়ে তুলতে পারি। তাদের দুইশ বছরের সাহিত্যের ইতিহাস-ঐহিত্য, সেখান থেকেও আমরা শিক্ষা নিবো। ভালো কিছুকে গ্রহণ করবো কিন্তু আমাদের দেশের কবি শিল্পী সাহিত্যিককে আমরা আগে প্রাধান্য দিব, এটাই আমি বলতে চাচ্ছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: কবি যখন প্রশাসক, অন্যদিকে কবির চিন্তা, এতে চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে নিশ্চয়ই?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: আমার মনোরাজ্যটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কর্মক্ষেত্রে আমি একজন কর্মী ও প্রশাসক হিসেবে কাজ করছি। সেখানে আমার গত ৩০ বছরের যে অভিজ্ঞতা, নজরুল ইনস্টিটিউটে কাজ করেছি সেখানে আমি প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছি। এখানে সেই কাজটিই করি। তবে এখানে পরিধিটা অনেক বড়। তাই আমাকে একটু বেশি সময় দিতে হচ্ছে কিন্তু আমি প্রতিদিন রাত ২-৩টা পযর্ন্ত পড়াশোনা করি, লেখালেখি করি।
পৃথিবীতে অনেক বড় বড় কবি লেখক যেমন পাবলো নেরুদা, রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। অক্তাবিও পাজ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আপনি জানেন যে, আমাদের দেশের আদিযুগে রাজ দরবারে কবিরা বড় বড় কাজ করেছেন। আলাওলও রাজ দরবারে বড় দায়িত্ব পালন করতেন। কৃষ্ণচন্দ্র সরকারেও একজন বড় কবি দায়িত্ব পালন করতেন। সুতরাং, কবিদের এই অভিজ্ঞতা শুধু আজকের না, বহুদিনের। দেশ মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে আমি শিল্পকলাকে অল্পসময়ের মধ্যে ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করব। সে ক্ষেত্রে আমার সহকর্মী সবাই আমাকে খুব সহযোগিতা করছেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন: ধন্যবাদ ভিউজ বাংলাদেশকে। আপনাদের পত্রিকা যেন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে থাকে। শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে সহযোগিতামূলক হিসেবে কাজ করলে আমরা খুবই আনন্দিত হবো।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে