Views Bangladesh Logo

রপ্তানিপণ্য তালিকায় নতুন পণ্য সংযুক্ত না করলে ট্যারিফ যুদ্ধে পরাজিত হতে হবে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি শুল্কারোপ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রচণ্ড উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। গত এপ্রিল মাসে প্রথম এ ধরনের বাড়তি শুল্কারোপের ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর তিন মাসের জন্য বাড়তি শুল্ক কার্যকর করা স্থগিত রাখা হয়। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর আরোপিত শুল্কহার কমিয়ে আনার চেষ্টা করে। অধিকাংশ দেশই এ ক্ষেত্রে সফলকাম হয়েছে। যেমন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর প্রাথমিক পর্যায়ে ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়েছিল। ভিয়েতনামের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ এবং ভারতের পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়েছিল। চীনের পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ হারে বাড়তি শুল্কারোপ করা হবে বলে জানানো হয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য চীনের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩০ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ভিয়েতনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক হার ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করাতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করলেও তারা মাত্র ২ শতাংশ শুল্ক কমাতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে আরও বাংলাদেশি আরও একটি প্রতিনিধি দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আরোপিত বাড়তি শুল্কহার ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর প্রাথমিকভাবে ২৬ শতাংশ বর্ধিত শুল্কারোপ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়; কিন্তু ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল ক্রয় করছে এই অজুহাতে ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর এভাবে বাড়তি শুল্কারোপ করল কেন? দেশটি এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা দেয়ার জন্যই এমন একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেকে আবার এমনও বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের প্রভাব দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনা পণ্য যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেশি পরিমাণে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্যই বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে যাদের অধিকাংশ দেশের সঙ্গেই ঘাটতে রয়েছে। যেসব দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়েছে তাদের প্রতিটি দেশের সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি রয়েছে।

করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক পর্যায়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অক আমেরিকা (ফেড) বারবার পলিসি রেট বাড়াতে থাকে। একই সঙ্গে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়; কিন্তু এ জন্য তাদের বড় ধরনের মূল্য দিতে হয়েছে। দেশের ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়। কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তাদের অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দেয়। এরই অংশ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করে।

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য তালিকায় সবার শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী দেশ হচ্ছে চীন। তারপর ভিয়েতনাম ও ভারতের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০২৪ সালে চীন বিশ্ব বাজারে মোট ১৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। চীনের বাজার হিস্যা ছিল ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। একই বছর বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে মোট ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। বাংলাদেশের বাজার হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। ভিয়েতনাম মোট ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তাদের বাজার হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ। আর ভারত মোট ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। তাদের বাজার হিস্যা ছিল ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন এবং ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের ওপর বাংলাদেশের তুলনায় বেশি হারে শুল্ক ধার্য করার ফলে আগামীতে আমাদের তেমন একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক সামগ্রির সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী হচ্ছে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর একই হারে বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়েছে। ফলে ভিয়েতনাম এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাড়তি সুবিধা পাবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর বাংলাদেশের তুলনায় কম শুল্ক ধার্য করায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা উল্লসিত হয়েছিল। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার দখলের স্বপ্ন দেখছিলেন; কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা ধূলিতে লুটিয়েছে। এখন বরং বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য বাজার দখল করার স্বপ্ন দেখতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ভারতের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যাঞ্চল অংশীদার। ভারত প্রতি বছর গড়ে ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। নিশ্চিতভাবে এই রপ্তানি কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে উঠে এসেছে। ওভেন এবং নিটওয়্যার রপ্তানিও বাড়তে শুরু করেছে। বর্ধিত শুল্কারোপের প্রাথমিক সিদ্ধান্তে ভীত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বায়ার বাংলাদেশকে দেয়া অর্ডার স্থগিত করেছিলেন। এখন তারা আবার সেই অর্ডার ফিরিয়ে আনছে। একই সঙ্গে নতুন নতুন অর্ডার প্লেস করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত শুল্কনীতির কারণে চীন এবং ভারতের তৈরি পোশাক খাতের বিনিয়োগ অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মতো দেশকে তাদের বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু এতে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়াটাই বড় কথা নয়। সেই বিনিয়োগ আহরণ করতে পারাটাই মূল বিবেচ্য বিষয়। অনেক দিন ধরেই আমাদের ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে মন্থরতা বিরাজ করছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকারে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কোন দেশে স্থানীয় বিনিয়োগ পর্যাপ্ত পরিমাণে আহরিত না হলে বিদেশি বিনিয়োগও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসে না।

বাংলাদেশে স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য নানা ধরনের আইন সুবিধা দেয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ আহরিত হচ্ছে না। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নানা আইনি বিধিনিষেধের কারণে চাইলেই অন্য দেশে গিয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন না; কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তারা ইচ্ছে করলেই যে কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশের বাস্তব বিনিয়োগ পরিবেশ এখনো বিনিয়োগ আহরণের জন্য অনুকূল নয়। বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অবস্থান ছিল ১৭৬তম। ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচক প্রকাশ বন্ধ আছে। তার পরিবর্তে বিশ্বব্যাংক গত বছর আর একটি নতুন সূচক প্রকাশ করেছে। এতে ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে চতুর্থ স্তরে।

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য অর্জিত হচ্ছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু মুখের কথায় বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। এ জন্য কার্যকর বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বর্তমানে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। উদ্যোক্তাগণ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করতে পারছে না। অধিকাংশ ব্যাংকই এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘ মেয়াদি পুঁজির জন্য সাধারণত ব্যাংকের ওপর নির্ভর করা হয় না। তারা পুঁজিবাজার থেকে প্রয়োজনীয় দীর্ঘ মেয়াদি তহবিল আহরণ করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের সহযোগিতা করার মতো অবস্থায় নেই। ব্যক্তি মালিকানাধীন বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজি বাজারে আসতে চায় না। এমনকি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের শেয়ার বাজারে আনার কথা থাকলেও তা করা যায়নি। আমি অর্থ উপদেষ্টা থাকাকালে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার বাজারে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম।

বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আমরা সীমিতসংখ্যক পণ্য এবং সামান্য কয়েকটি গন্তব্যে রপ্তানির মাধ্যমে এই খাতকে বিকশিত করার চেষ্টা চালাচ্ছি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। আর তৈরি পোশাক থেকে আসছে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের মতো। আমাদের রপ্তানিপণ্য তালিকায় নতুন নতুন পণ্য সংযুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে নতুন নতুন গন্তব্যে পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে।

ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা।
অনুলিখন: এম এ খালেক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ