ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট রাজনীতি কতটা শোভন!
কূটনীতির ক্রিকেট। রাজনীতির ক্রিকেট। ভারত ও পাকিস্তান অনেকগুলো বছর ধরে ক্রিকেটকে রাজনীতি এবং কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ব্যবহার করছে উভয় দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদ ‘সেন্টিমেন্টকে’। উভয় দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে ক্রিকেট তো ধর্মের সমতুল্য। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং ভোটের লড়াইয়ে ক্রিকেট একটি বড় বিষয় অনেকগুলো বছর ধরে।
ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ক্ষমতাসীন সরকার বেশি কৌশলী এবং আক্রমণাত্মক হলেও এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানও কম যায়নি। অনেকের হয়তো মনে আছে ২০০৫ সালে পাকিস্তানের বহুদূরগামী ক্ষেপণাস্ত্র ‘শাহিন টু’ নিশানা ভেদ করার পর তাদের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বলেছিলেন তিনি আনন্দিত এবং তৃপ্ত। কারণ হলো এতদিন তার দেশ ন্যূনতম প্রতিরোধ অস্ত্রের (ডেরারেন্ট) সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হন। ‘শাহিন টু’ ছোড়ার দুই সপ্তাহ আগে পাকিস্তান থেকে জানানো হয়েছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ চাচ্ছেন, ভারত বনাম পাকিস্তান ‘দোস্তি ক্রিকেট সিরিজ’ ম্যাচ ভারতে যেয়ে সশরীরে দেখতে, যদি তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আগ্রাসী কূটনৈতিক চান। তখন ভারত থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হয়েছে, তিনি দক্ষিণের কোচিন শহরে খেলা দেখবেন; কিন্তু পারভেজ মুশাররফের ইচ্ছা দিল্লিতে খেলা দেখবেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে খেলা দেখার পাশাপাশি কূটনৈতিক কথাবার্তা সেরে নেবেন। শেষ পর্যন্ত পারভেজ মোশাররফ দিল্লিতে খেলা দেখলেন এবং ভারতের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেছিলেন। ক্রিকেট ‘ডিপ্লোমাসি’ দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান স্নায়ুর চাপকে কিছুদিনের জন্য হলেও প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে।
ভারতীয় ক্রিকেট ব্যবসায়ীরা বিশ্ব ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। আইসিসি কখনো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতপার্থক্য এবং বিরোধে জড়াতে চায় না। তাদের বড় ‘মহাজন’ তো ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। আর এই মহাজনদের জন্যই তো আইসিসি ‘ফুলে ফেপে’ মোটা হচ্ছে সব সময়। মোটা হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তহবিল। প্রতি বছরই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ‘নেট লাভ’ ঊর্ধ্বমুখী। ক্রিকেট ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ‘মোড়লিপনা’ এবং অর্থনৈতিক দাপটের পেছনে আছে ব্যবসায়ীদের সমর্থন। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা সবাই ভারতীয় ক্রিকেট ব্যবসায়ীদের সমীহ করে কেননা অর্থের স্বাদ তো সবার কাছে মিঠা।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলাকে ঘিরে এত রেশারেশি এবং স্নায়ুর চাপে ভোগা হয় না। ভারত ও পাকিস্তান খেলছে ইংল্যান্ডে পুলিশ পাহাড়া দিচ্ছে আহমদাবাদে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। চুল থেকে পান খসলে আর উপায় নেই। এক সময় উভয় দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক হকি নিয়ে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতো। এখন আর সেই দিন নেই। উভয়ই ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র বনে গেছে। ক্রিকেট উভয় দেশের মধ্যে মর্যাদার লড়াই হিসেবে চিহ্নিত হয়। যদিও গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তান ভারতের তুলনায় মাঠের লড়াইয়ে অনুজ্জ্বল। ভারত ও পাকিস্তানের কিছু রাজনীতিকরা কোনো বিশেষ কারণে খেলা বলতে কেবল ক্রিকেটকে বুঝেন। ভোটের বাজারে ক্রিকেট ক্রেজকে কীভাবে উসকে দিয়ে পার্লামেন্টের নির্বাচনে ফায়দা লোটার চেষ্টা হয় সেটি একবার দেখেছি দিল্লিতে অবস্থানকালে।
উপমহাদেশে আইসিসি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট, চ্যাম্পিয়নশিপ, এসিসির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নিয়ে কত হৈচৈ, অনড় অবস্থানের পরও হাইব্রিড এবং নিরপেক্ষ ভেন্যুতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলা ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান ঠিকই খেলেছে। খেলেছে একই গ্রুপে। আর এই গ্রুপ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগে থেকেই পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়িত হয় সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে- এর পেছনে আছে ক্রিকেট বাণিজ্য এবং তাদের স্বার্থ। ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া তো আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট অলাভজনক হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে বাধ্য। ইকোনমি পাওয়ার উভয় দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
আসন্ন এশিয়া কাপের (টি-টোয়েন্টি) পূর্ণাঙ্গ সূচি ইতোমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে। ভারত আয়োজক হলে খেলা অনুষ্ঠিত হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। খেলা শুরু হবে ৯ সেপ্টেম্বর আর ফাইনাল ম্যাচ ২৮ সেপ্টেম্বর। দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে আট দল খেলবে এশিয়া কাপে।
গত ২৪ জুলাই সন্ধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেট সাংবাদিক স্বন্দ্বীপ প্যাটেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল। স্বন্দ্বীপ বলছেন, এখানকার ক্রিকেটের খবর হলো ভারত এবং পাকিস্তান একই গ্রুপে থাকছে। ড্র তো হয়নি? তাতে কী। একই গ্রুপে থাকা মানে ভারত ও পাকিস্তান সংযুক্ত আরবের দুবাইয়ে ফাইনালের আগে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে দুইবার লড়বে। আর যদি দুই দেশ শেষ পর্যন্ত ফাইনালে পৌঁছায়- তাহলে তো তিনবার। ক্রিকেট ব্যবসা হবে রমরমা। গত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হাইব্রিড মডেলে হয়েছে। আয়োজক ছিল পাকিস্তান। ভারত খেলেছে মধ্যপ্রাচ্যে। এবার এশিয়া কাপের ভেন্যু সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। দুবাইয়ে দর্শকের কমতি হবে না। এদিকে আইসিসি অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে আইসিসির চারটি ইভেন্ট হাইব্রিড মডেলে অনুষ্ঠিত হবে। কেননা এই চারটি আইসিসির ইভেন্টে ভারত ও পাকিস্তান দল একে অপরের দেশে যাবে না। এই দুই দেশের অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসি তাদের সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
ভারতীয় ক্রিকেট দল ২০০৮ সালের পর আর পাকিস্তান সফরে যায়নি। তবে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে পাকিস্তান দল ভারতে গিয়েছিল।
গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পরিবর্তনের পর চলতি আগস্ট মাসে ভারত তার বাংলাদেশ সফর আগামী এক বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদ দলের জন্য ভিসা প্রদান করতে বারবার অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবলে বাংলাদেশে ভারত দল খেলতে আসেনি। তাদের দেশে কাবাডি কম্পিটিশন, সাফ অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপ বাতিল করেছে। ইনজুরিতে পড়া বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ভারত আগের মতো জরুরি ভিত্তিতে ভিসা প্রদান করতে চাচ্ছে না।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে