খরচ কমানো, প্রবাহ বাড়ানো
মার্কিন GENIUS আইন থেকে বাংলাদেশের যা শেখার আছে
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। ২০২৪-২৫ অর্থবছর একাই এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। যার কারণে উপকৃত হয়েছে লাখ লাখ পরিবার এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয়কেও শক্তিশালী করেছে। অনেক পরিবারের জন্য এই টাকা শুধু অতিরিক্ত আয় নয়—এটি খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং বাসস্থানের মতো অত্যাবশ্যকীয় খরচ মেটানোর প্রধান উৎস।
এতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, দেশে টাকা পাঠানোর খরচ এখনও অনেক বেশি। প্রতি লেনদেনে প্রায় ৫ থেকে ৭ শতাংশ বেশি, যা বৈশ্বিক গড় খরচের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ধীরগতির ট্রান্সফার, উচ্চ ফি এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা রেমিট্যান্সের কার্যকারিতা সীমিত করছে। তাই, খরচ কমানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ানো এখন জরুরি প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ‘GENIUS Act—Guiding and Establishing National Innovation for U.S. Stablecoins Act’ বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর দৃষ্টান্ত হতে পারে। যদিও আইনটি যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক, এর মূল নীতিগুলো বিশ্বব্যাপী প্রযোজ্য। প্রযুক্তিনির্ভর পেমেন্ট ব্যবস্থা, ফিনটেক কোম্পানির জন্য স্পষ্ট নিয়মকানুন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তঃসংযোগ এবং স্বচ্ছ মূল্য জানানো—এসব বিষয় আইনটির মূল ভিত্তি। উদ্ভাবনকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করায় যুক্তরাষ্ট্রে রেমিট্যান্স আরও দ্রুত, সস্তা ও নিরাপদ হচ্ছে। বাংলাদেশও চাইলে এ ধরনের নীতি গ্রহণ করে তার রেমিট্যান্স ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাংক ও কিছু মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস—বিকাশ, নগদ, রকেট—রেমিট্যান্স ব্যবস্থায় প্রধান ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এগুলো অনেক সুবিধা বাড়ালেও গতি, খরচ ও পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এখনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। GENIUS আইনের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে একটি নিয়ন্ত্রিত স্যান্ডবক্স তৈরি করতে পারে, যেখানে ফিনটেক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো ব্লকচেইন, স্টেবলকয়েন ও ডিজিটাল ওয়ালেট ব্যবহার করে আন্তঃসীমান্ত পেমেন্ট সমাধান পরীক্ষা করতে পারবে। এতে মধ্যস্বত্বভোগী কমে যাবে, টাকা পৌঁছাবে কয়েক সেকেন্ডে, আর খরচও কমবে। দ্রুত ও সস্তা রেমিট্যান্স পরিবারগুলোর উপকারে আসবে এবং জরুরি খরচে তাৎক্ষণিক ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।
GENIUS আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বচ্ছতা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে ফি, বিনিময় হার ও প্রক্রিয়াকরণ সময় স্পষ্টভাবে জানাতে হয়। বাংলাদেশও এমন নিয়ম চালু করতে পারে। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, সেবার মান উন্নত হবে এবং প্রবাসীরা সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায়ে টাকা পাঠাতে পারবেন। এর ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়বে, ব্যাংকিং খাত হবে আরও শক্তিশালী, আর হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতির ব্যবহার কমে যাবে। এতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধেও সহায়তা মিলবে।
GENIUS–অনুপ্রাণিত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে খরচ কমাবে ছাড়াও অনেক সুফল বয়ে আনতে পারে। ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নত হলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে। যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, তারাও ডিজিটাল ওয়ালেট বা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে সঞ্চয়, ঋণ কিংবা বীমা সেবা পেতে পারবেন। কম লেনদেন খরচের ফলে পরিবারগুলো ব্যবসা, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে—যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর রেমিট্যান্স ব্যবস্থা ফিনটেক খাতকে উদ্ভাবনী সমাধান আনতে উৎসাহিত করবে। স্বয়ংক্রিয় আন্তঃসীমান্ত লেনদেন, রিয়েল-টাইম কারেন্সি কনভার্সন, এআই–নির্ভর জালিয়াতি প্রতিরোধ—এ ধরনের সেবা দেশে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ডিজিটাল ফাইন্যান্স কেন্দ্রে পরিণত করতেও সহায়তা করতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, একটি আধুনিক রেমিট্যান্স ব্যবস্থা অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়ন এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে শক্তিশালী করতে পারে।
তবে এসব বাস্তবায়নের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংক ও ফিনটেকের সমন্বয় জরুরি। নিরাপত্তা, ভোক্তা সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে উদ্ভাবনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা ও উদ্ভাবনের মধ্যে সমন্বয় করলেই কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের GENIUS আইন থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশটি রেমিট্যান্স খাতকে আধুনিক, দ্রুত ও কম খরচসাপেক্ষ করতে পারে। সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার, স্পষ্ট নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার—এসবই রেমিট্যান্সকে জাতীয় বৃদ্ধির এক শক্তিশালী ইঞ্জিনে রূপান্তরিত করতে পারে। এতে শুধু রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে না—আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি ডিজিটাল উদ্ভাবনও বাড়বে, যার সুফল পাবে লাখো পরিবার এবং শক্তিশালী হবে বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনীতি।
লেখক: ব্যাংকার এবং ডেটা সায়েন্স অনুরাগী
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে