স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশের পদযাত্রায় বাংলাদেশের ওষুধ খাতে নীতিমালা প্রণয়ন ও সক্ষমতা জোরদার জরুরি
বাংলাদেশের ওষুধ খাত আমাদের অন্যতম গর্ব। এ খাত দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা পূরণ করে, ফলে প্রতি বছর ৭-৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ওষুধ বাজার ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বর্তমানে খাতটি জিডিপির প্রায় ১.৮৩ শতাংশ অবদান রাখছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাতে প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করা যাচ্ছে। তবে এই খাতটি এখনো ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর। প্রতি বছর প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয় অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) আমদানিতে। দেশের তৈরি ওষুধ এখন ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে, যার পরিমাণ প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সঙ্গে এ খাত দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া তরুণদের জন্য বিপুলসংখ্যক অফিসভিত্তিক চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
এ খাতে বাংলাদেশ বর্তমানে যে ছাড় পাচ্ছে, এলডিসি উত্তরণের পর তা বন্ধ হয়ে যাবে। এখনো বাংলাদেশ রয়্যালটি না দিয়েই জেনেরিক ওষুধ ব্যবহার করতে পারছে; কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব বেড়ে যাবে। ওষুধের দাম বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের পকেট ফাঁকা হবে। এতে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে দেশে সীমিত গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালু আছে, যা মূলত শিল্প খাত নিজেরাই করে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো শক্তিশালী ও আধুনিক পরীক্ষাগার নেই অথচ ওষুধ তৈরির প্রতিটি ধাপে ল্যাব পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
২০২৩ সালের সংশোধিত পেটেন্ট আইন শিল্প খাতকে কিছুটা সহায়তা দিয়েছে, যেমন বাধ্যতামূলক লাইসেন্স (ট্রিপস ধারা ৩১) ব্যবহারের সুযোগ। তবে এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে জনস্বাস্থ্য সংকটে দ্রুত প্রয়োগ করা যায়। একইভাবে TRIPS-এর ধারা ৩০ অনুযায়ী ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের আগে জেনেরিক প্রস্তুত করার অনুমতি দিতে হবে, ধারা ৬ অনুযায়ী সমান্তরাল আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে বৈশ্বিক বাজার থেকে কম খরচে ওষুধ আনা যায়। এসবের জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, দক্ষ আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
বিডার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এখনো উন্নত এপিএ সংশ্লেষণ সুবিধা, পর্যাপ্ত বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স পরীক্ষাগার, আধুনিক প্রযুক্তি, শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বায়োলজিকসের জন্য ঠান্ডা চেইন অবকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানের বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স ল্যাব, বায়োটেক ও বায়োইনফরমেটিকস গবেষণাকেন্দ্র, প্রাণী পরীক্ষাগার, জিএমপি-সম্মত পাইলট প্ল্যান্ট এবং ভ্যাকসিন গবেষণা ইউনিট গড়ে তোলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এলডিসি-উত্তর সময়ে বাজার ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকে কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যুক্ত হতে হবে, বায়োসিমিলার ওষুধের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে এবং এপিআই রপ্তানি বাড়াতে হবে। তবে এসব উদ্যোগ শিল্প খাত একা নিতে পারবে না- প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক, আর্থিক, কারিগরি ও নিয়ন্ত্রক সহায়তা।
সাম্প্রতিক এক সেমিনারে জানানো হয়েছে, বর্তমানে ৬০০টি নতুন ওষুধ এবং ১৫টি উচ্চমূল্যের বায়োলজিকসের নিবন্ধন ঝুলে আছে যা উত্তরণের পর জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য; কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। সরকারও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
বিডার সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬৬ শতাংশ রপ্তানি মাত্র একটি এইচএস কোডের (এইচএস ৩০০৪৯০) মধ্যে সীমাবদ্ধ। পণ্য বৈচিত্র্যের অভাবের কারণে বৈশ্বিক বাজারে ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যে গুরুত্ব দিতে হবে। ট্রিপসের ছাড়গুলো পুরোপুরি ব্যবহার, এপিআই পার্ক চালু, বায়োসিমিলার ও বায়োলজিকসে মনোযোগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং দক্ষ জনবল তৈরি ছাড়া বাংলাদেশের ফার্মা খাতকে বৈশ্বিক খেলোয়াড়ে পরিণত করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে, প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প খাতের মধ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তরের সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্বে বায়োলজিক ওষুধ দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে যে বায়োসিমিলারগুলো হুবহু অনুলিপি করা যায় না, তবে এ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে যে এগুলো নিরাপদ ও কার্যকর। বায়োসিমিলারগুলো চিকিৎসায় আরও বিকল্প দেয় এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমাতেও সহায়ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বায়োসিমিলার উন্নয়নে শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্রও ভালো অবস্থানে। চীন দ্রুত এ ক্ষেত্রে অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশ এসব বায়োসিমিলার পণ্যে প্রবেশাধিকারের জন্য চীনের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে পারে। এর জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তা লাগবে। যারা দাবি করে যে তাদের প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে তাদের শিল্প খাতে কাজে লাগানো যেতে পারে।
ফার্মাসিউটিক্যাল সংশ্লিষ্টরা প্রস্তাব করেছেন যে ওষুধ নিবন্ধন ও অনুমোদন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। ডিজিজিডিএ এবং ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটির সক্ষমতা জরুরি প্রয়োজন। বাংলাদেশ একটি বৃহৎ ওষুধশিল্প গড়ে তুলেছে, সরকারও এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে, খাতটির ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে শক্ত রাজনৈতিক সহায়তা অপরিহার্য। কারিগরি বিষয়াদি, প্রযুক্তিগত সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন- সহযোগী দেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর অনুসরণে এগুলো গড়ে তোলা সম্ভব, যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে।
শেষ পর্যন্ত এটাই বলা যায়, দ্রুত ওষুধ নিবন্ধন ও অনুমোদন প্রক্রিয়া, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটির সক্ষমতা বৃদ্ধি, গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগ, শক্তিশালী আইপিআর সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং নিরবচ্ছিন্ন সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় ছাড়া ফার্মা খাতের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
ফেরদৌস আরা বেগম: অর্থনীতিবিদ ও প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে