এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি পেয়ে যা বললেন ফরহাদ মজহার

ইসলামবিরোধী ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট ও স্বঘোষিত খুনিদের হত্যার হুমকিকে ভয় করি না উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেছেন এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী তাকে ও আবুল সরকারকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'এভাবে নাগরিকদের হত্যার হুমকি তিনি প্রথম দিয়েছেন, তা নয়। এর আগেও দিয়েছেন। তবে তার ধারণা এতে বোধহয় আমি খুব ভীত হয়ে যাব। ইতোমধ্যে তার সন্ত্রাসী অনুচরেরা ফেসবুকে ও টেলিফোনে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে চলেছে। এই বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য জ্ঞানী ও মোমিনদের জন্য পেশ করছি। ইসলামকে সন্ত্রাসী ও স্বঘোষিত খুনিদের হাত থেকে বাঁচাতে এবং ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা আরও বিস্তারিত লিখে যাব, ইনশাল্লাহ।'
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দুইদিন আগে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী ফরহাদ মজহারকে কাফের আখ্যা দিয়ে শারীরিক নির্যাতন ও হত্যা করা জায়েজ বলে বক্তব্য দেন।
এর প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ফেসবুক পোস্টে জ্ঞানী ও মোমিনদের জন্য নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন ফরহাদ মজহার। এখানে তার লিখিত বক্তব্য পুরোপুরি তুলে ধরা হলো:
ইসলামে মানুষের জীবন এমন এক অমূল্য আমানত, যার হেফাজত আল্লাহ নিজেই মানুষের উপর নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব হিসেবে ন্যস্ত করেছেন। কোরআনের দৃষ্টিতে মানুষের জীবনহানি, কিংবা জীবনহানির হুমকি, শুধু একটি অপরাধ নয়—বরং সমগ্র মানবিক সভ্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমান। এই নৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান থেকেই বলা যায়, আব্বাসী কর্তৃক ফরহাদ মজহার ও আবুল সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হত্যার হুমকি—ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ, অন্যায়, এবং শরিয়তের মূলনীতির পরিপন্থী। বাইতুল মোকাররমের সামনে ২১ ফেব্রুয়ারি এবং গত কিছুদিন আগে এক মাহফিলে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা পরিষ্কার ভাবে ধর্মের নামে ঘৃণা ও সহিংসতা উস্কে দেওয়ার সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা। ইসলামের ন্যায়ধর্ম, বুদ্ধি ও সহিষ্ণুতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের আলোকে এই ঘোষণা তাই দ্বিগুণ বিপজ্জনক। কারণ এর দ্বারা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী ইসলামকে সন্ত্রাসীদের ধর্ম হিসাবে আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে এবং ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বঘোষিত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় না আনায় আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ভয়াবহ ক্ষয় ঘটেছে। সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে উপদেষ্টা সরকার বাংলাদেশকে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আমরা এই নব্য ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের সঙ্গে ইসলামের কোন যোগ আছে বলে মনে করি না। কুরআনে জীবনরক্ষার নীতি অটল ও সুস্পষ্ট। আল-মায়েদা ৫:৩২ আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার সমান। এই “অন্যায়ভাবে” শব্দটি শরিয়াহর বিচারব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর মাধ্যমে কুরআন প্রথমেই ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, আবেগ, মতবিরোধ বা তথাকথিত ধর্মরক্ষা—এই সবকিছুকে হত্যার বৈধ ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে দেয়। ইসলামে শাস্তি কার্যকর করার অধিকার রাষ্ট্রের, ক্বাজির, এবং বৈধ বিচারব্যবস্থার। কোনো আলেম, বক্তা, গোষ্ঠী বা জনতাকে আল্লাহ এই ক্ষমতা দেননি। ফলে ধর্মীয় ক্ষোভের ভিত্তিতে হত্যার হুমকি দেওয়া কুরআনের এই বিচার বা আদালত-কেন্দ্রিক ন্যায়বিচারের ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করে, এবং ইসলামের উপর জুলুম করে।
নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনে বহু মতবিরোধ, সমালোচনা এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক আচরণও প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো ব্যক্তিকে মতবিরোধের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেননি। মুনাফিক প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর বিরুদ্ধে যখন হত্যা দাবির মতো গম্ভীর আবেদনের মুখোমুখি হন, তখন তিনি বলেন—“মানুষ যেন না বলে, মুহাম্মদ তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করেন।” এই উক্তি শুধু একটি রাজনৈতিক সতর্কতা নয়; বরং ইসলামের নীতি—মতভেদ বা সমালোচনা, যত তীক্ষ্ণই হোক, তা কখনো হত্যাযোগ্য অপরাধ নয়। ধর্মীয় যুক্তি ও বিবেচনা ব্যক্তিগত রাগ বা উগ্রতার কাছে বন্দী নয়।
ফিকহের ধারাবাহিক পরম্পরায় তাকফির—অর্থাৎ কাউকে ঈমানহারা ঘোষণা করা—সর্বদা অত্যন্ত সতর্কতার বিষয়। চার মাজহাবের কোনো ইমামই সামান্য মতভেদে তাকফির সমর্থন করেননি। ইমাম নববী বলেছেন, “একজন মুসলমানকে ভুলভাবে কাফির বলা, তাকফিরকারী নিজেকেই বিপদে ফেলতে পারে।” ইমাম আবু হানিফা নীতিগতভাবে বলেছেন, “ক্ষমার ক্ষেত্রে ভুল করা উত্তম—শাস্তির ক্ষেত্রে ভুল করার থেকে।” এই বৈচারিক ও নৈতিক সতর্কতা ইসলামের নৈতিক , রাজনৈতিক ও আইনী ব্যবস্থা বিকাশের প্রধান ভিত্তি। জন্য কারণ শরিয়াহ জানে—শাস্তির মতো গুরুতর ক্ষমতা মানুষের হাতে দিলে সে তা সহজেই অপব্যবহার করবে। আব্বাসীর ভাষায় ফরহাদ মজহার বা আবুল সরকারকে ধর্মদ্রোহী বা কাফির আখ্যা দিয়ে তাঁদের ‘মৃত্যুদণ্ড’ দাবি করা মূলত এই ফিকহি নীতিরই সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইনি নিজেকে ইসলামি আলেম বলে দাবি করেন, কিন্তু ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উসকানি দেওয়াই তার পেশা।
ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিচারপদ্ধতি সবসময় কেন্দ্রীয় বা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ছিল। রাশিদুন খিলাফা হোক বা উমাইয়া-আব্বাসীয় প্রশাসন—হুদুদ বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেন কেবল রাষ্ট্রপ্রধান বা ক্বাজি। ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, উপজাতীয় সংঘাত বা ধর্মীয় অনুভূতির ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড কখনো অনুমোদিত হয়নি। বরং যাঁরা ধর্মের নামে ব্যক্তিগতভাবে হত্যার পথে নেমেছে—যেমন খারিজিরা—তাঁদের বিরুদ্ধে মুসলিম রাজনৈতিক ঐতিহ্য কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কারণ ধর্মের নামে শাস্তি প্রদানের একচ্ছত্র ক্ষমতা যদি ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সমাজে ন্যায়বিচার আর থাকে না; থাকে শুধু জাহিলিয়াত ও উগ্রতা।
বাংলাদেশের আইন ও আদালতেও মুসলমানদের বৈচারিক ও নৈতিক ঐতিহ্যের এই নীতিমালা বহন করে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৫০৬–৫০৭ ধারায় হত্যার হুমকি অপরাধ; সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও সহিংসতা বা ঘৃণা উস্কে দেওয়া স্পষ্টত নিষিদ্ধ। এই আইন বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে ভুল ভাবে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা ও উদারতা রক্ষা করতে হলে একে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি। এই ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিহাসের মধ্যে যেসব উদাহরণ রয়েছে সেখান থেকে আমাদের বহু কিছু শেখার রয়েছে। যাতে আব্বাসির মতো আর কেউ ধর্মের নামে কারো বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি দেওয়ার সাহস না করে।
এটা পরিষ্কার আব্বাসীর এই হুমকি ইসলামের বৈচারিক ও নৈতিক চেতনা, কুরআন–সুন্নাহর ন্যায়বোধ, ক্লাসিক ফিকহের তাকফির-বিরোধী অবস্থান, ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় বিচারব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো—সবকিছুকেই একযোগে অমান্য করে। ইসলামের রুহানিয়াত, বুদ্ধিবৃত্তি ও আলোচনার ঐতিহ্য—যা ভিন্নমতকে মোকাবিলা করে যুক্তি, ব্যাখ্যা, বুদ্ধি ও দাওয়াতের মাধ্যমে—সেই ঐতিহ্যকেই এই ধরনের উগ্র, সহিংস ও সন্ত্রাসী ঘোষণা ধ্বংস করে দেয়। ধর্মকে রাজনীতির উগ্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের এই প্রবণতা শেষ পর্যন্ত ইসলামেরই মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে; শান্তি, ন্যায় ও মানবজীবনের মর্যাদা—এই ইসলামী মৌল নীতিকেই আঘাত করে।
ইসলাম এমন এক সমাজ ও সভ্যতা গড়তে চায়, যেখানে মতভেদ থাকবে, বিতর্ক থাকবে, প্রশ্ন থাকবে—কিন্তু হত্যার হুমকি থাকবে না। অন্যকে চুপ করানোর নামে সহিংসতার বৈধতা ইসলাম কখনো দেয়নি। তাই আব্বাসীর এই হুমকি ইসলামের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ। যার বিরুদ্ধে আমরা দীর্ঘকাল ধরে লড়াই চালিয়ে এসেছি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আমলে সন্ত্রাসী আব্বাসী গং তৈরি হয়েছে। যে কারণে আব্বাসী জুলাই গণঅভ্যুত্থানকেও প্রকাশ্যে অস্বীকার করতে চায়। এনায়েতুল্লহ আব্বাসী আন্তর্জাতিক ভাবে ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিশাবে প্রমাণ করবার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সেনাপতি হতে চায়। এই ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি ধর্মের নামেই ধর্মের বিরুদ্ধে এবং সমাজরক্ষার নামেই সমাজকে ধ্বংস করতে চায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরণের সন্ত্রাসীর কোনো নৈতিক, আইনগত, কিংবা আধ্যাত্মিক বৈধতা নাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে