শ্রীমঙ্গলের পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরে শুরু আগাম নব দুর্গাপূজা
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ইছামতি চা-বাগানের মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরে ষষ্ঠী পূজায় শুরু হয়েছে বার্ষিক নব দুর্গাপূজা। সারা দেশের হাজারো ভক্তের আগমনে প্রথম দিনেই জমজমাট হয়ে উঠেছে মন্দির প্রাঙ্গণ।
দেশজুড়ে পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গোৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে আগামী রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর)। তবে, উপজেলার পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরটিতে দেবী দুর্গার নয়টি ঐশ্বরিক রূপের উদ্দেশ্যে পূজা হয় বলে ব্যতিক্রমী এই উৎসবটি নয়দিনের।
আয়োজক মঙ্গলচণ্ডী মন্দির ও সেবাশ্রম কমিটি জানায়, দেশের প্রাচীনতম শারদীয় দুর্গাপূজার উৎসবটি ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মন্দিরে উদযাপিত হয়ে আসছে বলে মনে করা হয়। তবে, ১৬ বছর ধরে এখানে নব দুর্গাপূজা হয়ে আসছে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, এই সময়কালে দেবী দুর্গা নয়টি রূপে আবির্ভূত হন। সেগুলো হচ্ছে, শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী ও সিদ্ধিধাত্রী। নবপূজার আয়োজকরা ভিন্ন ভিন্ন দিনে এসব রূপের আরাধনা করে থাকেন। তবে, দেশের অন্য কোথাও আগাম দুর্গাপূজার এমন আয়োজন নেই।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) উদ্বোধনী দিনে মন্ত্রোচ্চারণ, নৈবেদ্য এবং পবিত্র আচার-অনুষ্ঠানে দেবী শৈলপুত্রীর কাছে প্রার্থনা করছেন ভক্তরা। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) মহাসপ্তমীতে দেবীকে ব্রহ্মচারিণী হিসেবে সম্মান জানানো হবে। আগামী নবমী তিথি পর্যন্ত চলা এই পূজার প্রতিদিন দেশের শান্তি ও কল্যাণ কামনায় দেবীর চরণে অঞ্জলি দেবেন ভক্তরা।
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, শ্রীমঙ্গলের এই মন্দিরেই শুধুমাত্র প্রতিদিন একেকটি রূপে দেবীর পূজা হয়। ভক্তি ও শাস্ত্রীয় রীতিনীতির কঠোর আনুগত্যের সাথে সব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান চলবে।
তিনি আরও জানান, দুর্গাপূজায় যে চণ্ডীপাঠ করা হয়, সেখানে দুর্গা দেবীর নয়টি রূপের কথা বলা আছে। তাই এখানে আলাদা আলদাভাবে দুর্গার নয়টি রূপের পূজা করা হয়ে থাকে। অনেকেই দেবীর নয়টি রূপ সম্পর্কে জানেন না। এখানে এসে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা পান ভক্ত-পুণ্যার্থীরা।
ধর্মীয় নানা আয়োজনের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটির প্রাঙ্গণে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মেলাও। সেখানকার খাবারের স্টল ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। তাই, পূজা ও মেলা ঘিরে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া মন্দিরটিতে তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের মিলনমেলা বসেছে।
স্থানীয় ভক্ত দীপালি দাস বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলের এটিই একমাত্র মন্দির, যেখানে দেবী দুর্গার নয়টি রূপের পূজা হয়। এটি মনের গভীর লালিত ঐতিহ্য, যা আমরা প্রতি বছরই প্রত্যাশা করি’।
মৌলভীবাজারের দর্শনার্থী ভাবনা রায় বলেন, ‘আমি প্রথমবারের মতো এখানে নব দুর্গাপূজা দেখতে পেরে রোমাঞ্চিত। এটি আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা, যাতে আমি সত্যিই ধন্য বোধ করছি’।
তিনি জানান, চা-বাগানের এই মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরে মহালয়া থেকে শুরু হওয়া এই নব দুর্গাপূজা গত ১৫ বছর ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ-উদ্দীপনারও সৃষ্টি করেছে। শারদীয় দুর্গাপূজার মূল আয়োজনের আগে এই আগাম পূজা স্থানীয় ও বাইরের ভক্তদের কাছে বিশেষ ধর্মীয় মিলনমেলায়ও রূপ নিয়ে থাকে।
উৎসবের এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও আয়োজকরা বলছেন, মন্দির ও এর আশপাশের এলাকায় যথাযথ অবকাঠামো ও সরকারি স্বীকৃতির অভাব রয়েছে।
শ্রী শ্রী মঙ্গলচণ্ডী সেবাশ্রম নবরূপে নবদুর্গা পূজা উদযাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক কৃপেশ কর্মকার বলেন, ‘আমরা দেড় দশক ধরে এখানে নব দুর্গাপূজা করে আসছি। কিন্তু এখনও এই স্থানে মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে’।
উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাজন চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রতি বছর ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্বেগের বিষয়ে সরকারের জরুরি মনোযোগ প্রয়োজন’।
নব দুর্গাপূজা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই উৎসবের অন্যতম আয়োজক উদযাপন পরিষদের সভাপতি পরিমল ভৌমিক বলেন, মন্দিরটি দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে আসছে। পবিত্র এই স্থানটি পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন উপাসনালয়। এটি সংরক্ষণ ও জাতীয় স্বীকৃতির দাবি রাখে’।
সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত দাশ বলেন, ‘আমরা ২০১০ সাল থেকে এখানে নবদুর্গা পূজার আয়োজন করছি। এ বছর আমাদের ১৬তম আয়োজন। সারা দেশে দুর্গাপূজা শুরুর আগেই আমরা পূজা শুরু করি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা এখানে আসেন। আমরা চাই, এই আয়োজনের মাধ্যমে দেশে শান্তি ও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনুক’।
নয় দিনের উৎসবের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে