সাকিব কি দেশের হয়ে খেলার অধিকার রাখেন
আমাদের দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান কি আবারও জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবেন? তিনি কি এখনো তার প্রিয় মাতৃভূমির হয়ে খেলার অধিকার রাখেন? দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আজ সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন এটাই অথচ কোনো স্পষ্ট উত্তর আমাদের হাতে নেই।
প্রথমেই প্রশ্ন জাগে- বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের দেশের হয়ে খেলার অধিকার আছে কি না- এ নিয়ে আলোচনা করার দরকারই বা হলো কেন? এ প্রশ্ন তোলাই তো বিশ্বজুড়ে খেলাপ্রেমীদের কাছে অকল্পনীয়। আর এমন অদ্ভুত প্রশ্ন কেনইবা উঠল, তার উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরতে হবে ঘটনার শুরুর দিকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই-দেশের নাগরিকরা দেখেছেন জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বাঁচিয়ে দেয়ার এক অদ্ভুত আয়োজন শুরু হলো। চোখের সামনে দেখা গেল কীভাবে ন্যায়বিচার ব্যর্থ হওয়ার বীজ বপন করা হলো। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করার পরপরই নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন হত্যা মামলা দেয়া শুরু হলো। এই মামলাগুলোই সাকিবের খেলার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার পথ প্রশস্ত করল, কারণ ৫ আগস্ট আদাবরে এক গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যা মামলায় তিনিও অভিযুক্ত।
মনে আছে? শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথম মাসেই প্রতিদিন অগনিত মামলা দেয়া হচ্ছিল- একেকটি মামলায় ১০০, ২০০, এমনকি ৩০০ জনের নাম জুড়ে দেয়া হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের সঙ্গে ঘটনার সামান্যতম সম্পর্কও ছিল না। যার ফলে তদন্ত কর্মকর্তা কিংবা আইনজীবীর পক্ষে কার্যকর বিচার এগিয়ে নেয়া এককথায় অসম্ভব হয়ে গেল। জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার আসলে একটি হেরে যাওয়া লড়াই।
আপনি-আমি যখন কাউকে বিচার করি, তা জনমতের শামিল হতে পারে; কিন্তু জুলাই হত্যা মামলাগুলোর বিচার হবে প্রকৃত আদালতে, যেখানে অভিযোগ প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হবে প্রসিকিউশনকে।
বেদনার বিষয় হলো, আমরা যারা জুলাই হত্যাযজ্ঞের ন্যায়বিচারের দাবিদার তারা নিজেরাই সঠিক সময়ে ন্যায়বিচারের আওয়াজ তুলিনি। ২০২৪ সালের আগস্টই ছিল ভুলগুলো ঠিক করার সঠিক সময়; কিন্তু অযথা অসংখ্য মানুষকে একসঙ্গে অভিযুক্ত করার মাধ্যমে বিচারের পুরো প্রক্রিয়া পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
সেই সময় একের পর এক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের খবরের নিচে ন্যায়বিচারের আসল দাবি চাপা পড়ে গেল। অথচ তখন আমরা নীরব থাকলাম। আমরা বলিনি- ‘এমন হাস্যকর মামলা দেয়া বন্ধ করুন, এতে কোনোদিনই অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব নয়।’ আমরা বলিনি- ‘জুলাই হত্যাযজ্ঞে যাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই তাদের নাম বাদ দিন।’ যদিও আমরা সকলেই জানতাম নামগুলো কেবল রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যুক্ত করা হচ্ছে, তারপরও প্রতিবাদ করিনি। ফলে মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেল।
আমরা দাবি করিনি যে, পুরো চেইন অব কমান্ডকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে- যে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব বা সেনাসদস্য গুলি চালিয়েছিল, যে ম্যাজিস্ট্রেট বা অফিসার আদেশ দিয়েছিল সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।
সাকিবের নামে হত্যা মামলা হলো ২৩ আগস্ট ২০২৪। যেখানে ৫ আগস্ট আদাবরে গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হলো। শেখ হাসিনার পতনের এক-দুই দিনের মধ্যেই এমন সাজানো মামলার খেলা শুরু হয়েছিল, সম্ভবত পূর্বপরিকল্পিতভাবেই। আর এভাবেই শুরু হলো বিচার নামে প্রহসনের যাত্রা।
মিডিয়া রিপোর্ট বলছে, মামলায় নাম যুক্ত বা বাদ দেয়ার নামে একদল সুবিধাভোগী তরুণ এটিকে রীতিমতো বাণিজ্যে পরিণত করেছিল।
আমরা তখনো জানতাম, এখনো জানি- এই মামলাগুলো টেকসই নয়। আমরা জানি- এ গণঅভ্যুত্থানকালে হওয়া হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হবে না। শুরুতেই যদি আমরা বলতাম, “এভাবে হবে না,” তবে হয়তো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতো; কিন্তু এভাবে অপেশাদার পদ্ধতিতে কোনোদিনই বিচার মেলে না।
সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব নয়- এটা সবাই জানে। ১২৩ জনের মধ্যে তিন-চারজনের জড়িত থাকা হয়তো কোনোভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে, তবে সেটিও কঠিন। আর সাকিব? তার ক্ষেত্রে তো একেবারেই অসম্ভব।
তবুও তার জন্মগত অধিকার আছে নিজ দেশে ফেরার। আর সে অধিকার কেউই কেড়ে নিতে পারে না। ধরা যাক তিনি আওয়ামী লীগের এমপি হয়ে ভুল করেছেন, আন্দোলনকে সমর্থন না করে অপরাধ করেছেন। তবুও তা তার মাতৃভূমিতে ফেরার অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। যদি সত্যিই তিনি অপরাধ করে থাকেন তবে আদালতে বিচার হোক; কিন্তু তাকে দেশে ফিরতেই দেয়া হবে না কেন? কেন বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডারকে ক্রিকেট থেকে দূরে রাখা হবে?
আমরা মনে করি সাকিবের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে এবং তার জন্মগত ও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে। দেশের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদের অধিকার যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি, তবে সাধারণ নাগরিকদের কী হবে?
তাহলে তার অপরাধ কী? একটি বিতর্কিত, কারচুপির নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হওয়া এবং জুলাইয়ের রক্তাক্ত দিনগুলোতে নীরব থাকা- তার বিরুদ্ধে অভিযোগ মূলত এগুলোই। এই তথাকথিত অপরাধের কারণে তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না- যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সম্প্রতি ফেসবুকে তা স্বীকারও করেছেন। অথচ সাকিব নিজেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচটি দেশের মাটিতে খেলার; কিন্তু সে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। আমরা তাকে কী দিলাম, আর বিনিময়ে, সারজীবন ধরে তিনি জাতিকে কতটা দিয়েছেন- তুলনা করলে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। সাকিবের প্রতি এমন আচরণ করার পর জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।
প্রশ্ন আসে, ‘তিনি কি এ আচরণের যোগ্য? জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরও তিনি কি এভাবে পদে পদে লাঞ্ছনার শিকার হতে থাকবেন? নিজের ঘর জ্বালিয়ে দেয়া, দেশে প্রবেশে বাধা- এসব যন্ত্রণা কি তার প্রাপ্য?’ অবশ্যই না। কারণ সাকিবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ- আন্দোলনের সময় নীরব থাকা- তা প্রকৃতপক্ষে কোনো অপরাধই নয়, এটি সবারই জানা। এটি তার নিজস্ব স্বাধীনতা বিষয় হতে পারে তবে অপরাধ নয়।
যে সাকিব শত শতবার আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়েছেন দেশের মানুষকে, গর্বে ভরিয়ে তুলেছেন কোটি কোটি বাংলাদেশির বুক; আমরা তাকে ছেড়ে দিয়েছি একদল রাতারাতি ক্ষমতাসীন বখে যাওয়া তরুণের হাতে, যারা প্রতিটি পদক্ষেপে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। সাকিব হয়ে উঠেছেন তাদের ট্যাগ সংস্কৃতির বলি- ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’।
আজ বাস্তবতা হলো- জুলাইয়ের মামলার শত শত আসামি রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মধ্যে আছে সেনা-পুলিশের বড় বড় কর্তাসহ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত; কিন্তু সাকিব আল হাসান নিজের দেশেই ফিরতে পারছেন না তথাকথিত ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’। খেলার সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা।
তাহলে মূল প্রশ্নে ফিরে আসি- সাকিব কি জাতীয় দলে খেলার অধিকার রাখেন? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে সরকার কেন তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়নি এবং দিচ্ছে না? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখানে নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, লঙ্ঘন ঘটাচ্ছে নাগরিক অধিকারের। সাকিবের খেলার অধিকার থাকলে তাকে খেলতে দেয়া উচিত।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে