বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং: ব্যবসায়িক মডেল, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে দুবার দেশে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য আবেদন আহ্বান করেছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নাগাদ ও কড়ি- এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সেই লাইসেন্সগুলো স্থগিত করা হয়।
সংশোধিত নীতিমালায় বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ১২৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে এবং “Guidelines to Establish Digital Bank – Version 2” প্রকাশ করেছে। উভয় সংস্করণেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডিজিটাল ব্যাংক নিজস্ব শাখা, এটিএম, সিডিএম বা সিআরএম স্থাপন করতে পারবে না; বরং একটি মাত্র প্রধান কার্যালয় থেকে তৃতীয় পক্ষের কাস্টমার সার্ভিস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জনমিতিক গঠন ডিজিটাল ব্যাংকিংকে একটি সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত করেছে।
মিলেনিয়াল ও জেনারেশন জেড প্রজন্ম এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং এরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে সক্রিয় ব্যবহারকারী। ফলে ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রচলিত ব্যাংকগুলো শাখাভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলের ওপর নির্ভরশীল হলেও, ডিজিটাল ব্যাংককে সম্পূর্ণ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও কল সেন্টারের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। এ জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের শুধু লেনদেনভিত্তিক কাজের বাইরে গিয়ে গ্রাহকদের পরামর্শমূলক সেবা দিতে সক্ষম হতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে তাদের কর্মীদের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে প্রশিক্ষিত করা ও গ্রাহকদের শিক্ষা দেওয়া জরুরি- ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া, পডকাস্ট, ইনফ্লুয়েন্সার, টেলিভিশন ও প্রচলিত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এতে আস্থা গড়ে উঠবে, আর্থিক সাক্ষরতা বাড়বে এবং ডিজিটাল পরিবেশে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
অনেকে মনে করেন, BEFTN, RTGS, NPSB এবং MFS চালু হওয়ার পর নগদ অর্থ বা বেয়ারার চেকের প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে। বাস্তবে, কিছু ব্যবসার প্রকৃতি ও গ্রাহকের বিশেষ চাহিদার কারণে প্রচলিত লেনদেন পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে হবে। তবে এসব পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে নিরাপদ কিউআর (QR) কোড ও অন্যান্য আধুনিক পেমেন্ট টুল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা দ্রুত, সহজ ও নিরাপদ। ডিজিটাল ব্যাংকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হবে সাইবার নিরাপত্তা। যেহেতু তাদের সম্পূর্ণ কার্যক্রম এপিআই (API) সংযোগের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাই সাইবার নিরাপত্তা শুধু কার্যক্রমের টেকসইতার জন্যই নয়- বরং বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এই ঝুঁকি মোকাবিলায় ডিজিটাল ব্যাংকগুলোকে Zero Trust Security Framework, মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (যেমন OTP), ধারাবাহিক হুমকি পর্যবেক্ষণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। তাদের কোর ব্যাংকিং সিস্টেম এমনভাবে নকশা করা উচিত যাতে নতুন সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহজে সংযোজন করা যায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো প্রতারণা প্রতিরোধ। ব্যাংক খাতে নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ডিজিটাল ব্যাংকে সরাসরি গ্রাহক সংযোগ কম থাকায় ঝুঁকি বেশি। তাই কল সেন্টার- যা গ্রাহক যোগাযোগের মূল কেন্দ্র- নিজস্বভাবে পরিচালনা করা উচিত, তৃতীয় পক্ষের কাছে আউটসোর্স না করে।
এই উদ্দেশ্যে, শক্তিশালী KYC, CDD এবং EDD প্রক্রিয়া প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর হিসেবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি, মেশিন লার্নিং–ভিত্তিক অ্যানোমালি ডিটেকশন প্রযুক্তি শুরু থেকেই সংযুক্ত করা উচিত, যা লেনদেনের ধরন বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক কার্যক্রম চিহ্নিত করবে এবং ক্রমবর্ধমান প্রতারণার কৌশলের সঙ্গে খাপ খাওয়াবে। বিশ্ব যখন নগদভিত্তিক অর্থনীতি থেকে ক্যাশলেস সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছে, ডিজিটাল ব্যাংকই হবে আগামী দিনের ব্যাংকিং শিল্পের অগ্রদূত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্ভাবনী পণ্য দিয়ে আজকের ডিজিটাল ব্যাংকগুলো আগামী দিনের নেতৃত্বে আসতে পারে।
যদিও দেশে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট কিছু অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে, তবুও কার্যকর নীতিমালা ও দৃঢ় তদারকি থাকলে ডিজিটাল ব্যাংকগুলো শক্ত অবস্থান নিতে পারবে। এক দশক আগে কেউ ভাবেনি যে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) লেনদেনের দিক থেকে ব্যাংকিং খাতকে ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু তা আজ বাস্তবতা। একইভাবে, ডিজিটাল ব্যাংকও ভবিষ্যতে নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। তবে তাদের প্রতিযোগিতা কেবল ডিজিটাল ব্যাংকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; প্রচলিত ব্যাংকগুলোও দ্রুত তাদের ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। তাই সফল হতে হলে ডিজিটাল ব্যাংককে গ্রাহককেন্দ্রিক কৌশল, উদ্ভাবনী পণ্য, এবং উন্নত প্রযুক্তি- বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা অ্যানালিটিকস- ব্যবহারের মাধ্যমে অগ্রগামী হতে হবে।
সবশেষে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডিজিটাল ব্যাংকিং তদারকির জন্য বিশেষায়িত টিম, উন্নত মনিটরিং টুল এবং রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, গ্রাহকসেবা প্রদানের জন্য নন-ট্রানজেকশনাল সার্ভিস বা পরামর্শকেন্দ্র চালুর অনুমোদন দেওয়া এবং লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত, যাতে উদ্ভাবন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ বাড়ে। সর্বোপরি, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তুতিই নির্ধারণ করবে দেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং খাতের স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও সাফল্যের ভবিষ্যৎ।
ওবেদুর রশিদ বিন সকরাত কাদেরি: ব্যাংকার ও ডেটা সায়েন্স অনুরাগী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে