Views Bangladesh Logo

মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা স্টুপিডিটি ছাড়া আর কিছু না

দরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের লেখক-গবেষক ও বামপন্থি রাজনীতিবিদ। তার জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমান শহরে। তিনি আজ রোববার ৯৪ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। তার ৯৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারটি দুই পর্বে প্রকাশিত হয়েছিল ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ও ৫ জানুয়ারি ২০২৫ সালে। আলোচিত সাক্ষাৎকারটিতে উঠে এসেছে বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক দর্শন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনা। ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশিত হলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক


ভিউজ বাংলাদেশ: স্বৈরাচারী এরশাদের পর শেখ হাসিনারও পতন হলো। এভাবে আমাদের দেশে বারবার কেন স্বৈরাচারের জন্ম হচ্ছে? আমরা কি সত্যিই গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করতে পারব, না কি আবার কোনো স্বৈরশাসকের কবলে পড়ব?

বদরুদ্দীন উমর: স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কেন বারবার আসছে এটা বুঝতে হলে শ্রেণি প্রশ্ন বুঝতে হবে। যেটা এ দেশের রাজনীতি-বিশ্লেষক, ইতিহাসবিদরা একদমই করেন না। স্বৈরতন্ত্র মানে কী? এটা শ্রেণির একক শাসন। যেখানে অন্য কারো কোনো স্বাধীনতা নাই। এখন এটা দেখতে হবে কেন এভাবে বারবার আমাদের দেশে স্বৈরশাসেকের জন্ম হচ্ছে। স্বৈরশাসক যে শুধু এরশাদ, হাসিনা ছিল তাই তো না। শেখ মুজিবও একজন স্বৈরশাসক, ফ্যাসিস্ট ছিলেন। জিয়াউর রহমানও একজন ফ্যাসিস্ট ছিলেন। জিয়াউর রহমান জনগণের ওপর অতটা নির্যাতন করেননি, তার দরকারও হয়নি। শেখ মুজিব এমন নির্যাতন করেছিলেন যে, তিনি যাওয়ার পর কোনো বিরোধিতা ছিল না। জিয়াউর রহমানের তাই দরকারই ছিল না নির্যাতন করার। দরকার হলে তিনি করতেন। যেমন খুলনা জেলে গুলি করে তিনি ২০০ লোক মেরে ফেলেছিলেন। সামরিক বাহিনীরও অনেক লোক মেরে ফেলেছিলেন। দরকার হলে তিনি অন্য লোকদেরও মারতেন; কিন্তু দরকার হয়নি। তার এটুকু বুদ্ধি ছিল যেটা অদরকারি সেটা করার দরকার নেই। যেটা শেখ মুজিবের ছিল না বলে মনে করি। যেসব মানুষ তাকে ১০ জানুয়ারি এমন গণসংবর্ধনা দিল তাদের তিনি মারতে শুরু করলেন। তার এত জনপ্রিয়তা ছিল, সে অবস্থায় দু-চারজন লোক তার সমালোচনা করত কী আসে-যায় তাতে! ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি কাউকেই জিততে দিলেন না। দুচারজন রাজনীতিবিদদের জিততে দিলে কী হতো? তিনি দিলেন না। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন, বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই। বাহাদুরি দেখালেন। আরে, কী ধরনের কথা!

যাই হোক, এটা সম্ভব হচ্ছে এই জন্য যে, দেখতে হবে কোন শ্রেণি ক্ষমতায় আছে। বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেয়া যাবে না; কিন্তু এটুকু বলা যায়, আওয়ামী লীগ কোনো উৎপাদন শ্রেণির দল ছিল না, জমির মালিক ছিল না, শিল্পের মালিক, ব্যবসার মালিক ছিল না, ছিল মধ্যস্বত্বভোগী। উকিল-মোক্তার-শিক্ষক-বেকার যুবক- দোকানদার- এসব দিয়েই তো আওয়ামী লীগ হয়েছিল। তারা যখন ক্ষমতা পেল তখন ধন-সম্পত্তি অর্জন করবে কীভাবে? উৎপাদনের মাধ্যমে তো সম্ভব না। কাজেই বিদ্যমান যে সম্পদ সেটাকেই তারা লুট করতে শুরু করল। পরে বিহারিদের ঘরবাড়ি, অন্য যারা অবাঙালি তাদের ধন-সম্পত্তি তারা লুট করতে আরম্ভ করল। তারপর জাতীয় সম্পদ সব জাতীয়করণ করে চারদিকে লুটপাট করতে শুরু করল। লুটপাট করে তাদের হাতে যে টাকা চলে এল সেটা কী করবে তারা? ২৫ লাখ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে দিচ্ছিল শিল্পপতিদের সঙ্গে। তারপর তারা চোরাচালান, চোরাকারবার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল। বাংলাদেশে যে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি তৈরি হলো, বলা যায় যে এর কারণেই পরবর্তীতে এসব ঘটনা ঘটেছে। মধ্যস্বত্বভোগী ইউরোপে তৈরি হয়েছিল শিল্প যারা করত, উদ্যোক্তরা শ্রেণিদের নিয়ে। ভারতেও মধ্যস্বত্বভোগী হয়েছিল যারা জমিদার শ্রেণি থেকে এসেছিল, চাকরি-বাকরি করত সরকারের তাদের নিয়ে। পাকিস্তান আমলেও তাই, যারা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করত তাদের নিয়েই মধ্যস্বত্বভোগ্য হয়েছিল। আর বাংলাদেশে মধ্যশ্রেণি তৈরি হলো লুটপাটের মধ্য দিয়ে। এই মধ্যশ্রেণি হচ্ছে লুণ্ঠনজীবী। এবং এই লুণ্ঠনজীবী থেকে তাদের হাতে যে সম্পদ জড়ো হলো, সেই সম্পদ নিয়ে যেহেতু তারা শিল্পকলকারখানা করতে পারে না, ব্যবসা করতে পারে না সেহেতু তারা চোরাচালানীর মধ্যে চলে গেল।

এই চোরাচালানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটা ব্যবসায়িক শ্রেণি তৈরি হলো, একটা মধ্যশ্রেণি। এই মধ্যশ্রেণিই বিকশিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ব্যবসায়ী শ্রেণি। সেই জন্যই দেখা যাবে হাসিনার সংসদে শতকরা আশিজন হচ্ছেন ব্যবসায়ী। বাকি যারা আছেন তারাও ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত। কোনো দেশে এটা হয়? যেটা সাধারণত হয়, রাজনীতিক ব্যক্তিরা বড় বড় ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেন; কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিনিধিত্ব করার ব্যাপার নাই। ব্যবসায়ীরা নিজেরাই ক্ষমতায়। যারা ক্ষমতায় আছে তারা কেউ রাজনীতির লোক না, তারা সব ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের মধ্যে এখানে কার্যত কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। রাজনীতির লোক মানেই এখানে ব্যবসাদার। আর ব্যবসাদার মানেই সে মনে করে সে রাজনীতি করতে পারে। এই অবস্থা যেখানে এসেছে, স্বৈরশাসনের বীজ সেখানেই রয়েছে। এখানে জনগণের যে ব্যাপক সম্পদ লুট হচ্ছে, কার্ল মার্কস তার ক্যাপিটেল গ্রন্থে অনেক আগে লিখে গেছেন, ‘যখন একটা দেশে এ ধরনের ব্যবাসায়িক শ্রেণি ক্ষমতায় আসে, তখন তাদের হাতে চারদিকে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগ-দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটনা ঘটে।’ বাংলাদেশে দেখা যাবে, ১৯৭২ সালে যে ব্যবসায়িক শ্রেণি তৈরি হলো তাদের হাতেই বাংলাদেশ শাসন হচ্ছে। এই ব্যবাসায়িক শ্রেণি ক্ষমতায় আসার পরেই চারদিকে এমন একটা নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এই স্বৈরশাসনের শুরু হয়েছে শেখ মুজিবের আমল থেকেই। এরশাদ বা হাসিনার আমল থেকে না। বাংলাদেশে শুরু থেকেই স্বৈরশাসন ছিল।

ভিউজ বাংলাদেশ: মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া গঠন করা কি সম্ভব?

বদরুদ্দীন উমর: মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা স্টুপিডিটি ছাড়া আর কিছু না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করা সম্ভব? যা ঘটে গেছে তাকে কোনোভাবে অস্বীকার করা সম্ভব না। আপনি কি ইংরেজকে অস্বীকার করতে পারেন? আকবর-বাদশাকে অস্বীকার করতে পারেন? চন্দ্রগুপ্তকে? তাদের তো অস্বীকার করা যাবে না। এই যে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার কথা উঠছে, এটা একটি স্টুপিড কথা। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার সমালোচনা থাকতে পারে, বক্তব্য থাকতে পারে, অস্বীকার করবেন কী করে? অস্বীকার তো করতে পারেন না। অস্বীকার করার এই যে প্রবণতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব সময় একরকম থাকে না একটি দেশে। পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও পরিবর্তন হয়। অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব একটি পরিবর্তন সম্প্রতি হয়েছে, তার ফলে কিছু নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা তো অনিশ্চিত ব্যাপার। যে ছাত্ররা এই আন্দোলন করেছে, তারা একটি দল করতে যাচ্ছে। এখন ছাত্ররা ছাত্র হিসেবে কোনো দল করতে পারে না। কারণ ছাত্রত্ব তো আজ আছে কাল নেই। কাঠামোগতভাবে ছাত্র হিসেবে কোনো দল থাকতে পারে না; কিন্তু যেসব ছাত্র পাস করে বেরিয়ে এসেছে তারা তো দল করতেই পারে। যারা এখন রাজনৈতিক নেতা তারাও তো ছাত্র ছিল এক সময়। ছাত্র ছিল, এখন রাজনীতি করতে গেলে তারা তো আর ছাত্র নেই। কাজেই গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, এখন রাজনীতি করতে চাচ্ছে, দেখা যাবে তারা আর ছাত্র নেই। তারা সাধারণ নাগরিকের পর্যায়ে এসেছে। তারা দল করতেই পারে।

এই যে বলছে, দুটি অংশ আছে, একটি নাগরিক কমিটি, আরেকটি বৈষম্যবিরোধী। এখন কী দল করবে, ল করলে সেটা কীরকম দাঁড়াবে সেটা দেখতে হবে। তারা যে দল করবে তা তো সমাজতান্ত্রিক দল না। তারা যে দল করবে তা বুর্জোয়া শাসনের মধ্যেই হবে। বিএনপির বিকল্প হবে। গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে হয়তো বিএনপির চাইতে কিছুটা শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে। কী হবে এটা তো আমরা এখনো বলতে পারছি না। তবে এর একটি সম্ভাবনা আছে, যে নতুন রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হবে। আওয়ামী লীগ তো বিদায় হয়ে গেছে। এখন বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসেবে এই রাজনৈতিক দল দাঁড়াবে। একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে এই দল দাঁড়াবে। এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক কোনো উপাদান নাই। তার কারণ, এই যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এটা তো কোনো সমাজ বিপ্লব না। সমাজ বিপ্লব হলে শ্রেণির পরিবর্তন হয়। সেরকম তো কিছু হয়নি। যে শ্রেণি ক্ষমতায় ছিল সে শ্রেণিই আছে। যে ব্যবসায়িক শ্রেণি শাসক শ্রেণি হিসেবে ১৯৭২ সাল থেকে আছে, তারা তো মহাশক্তিশালী। ছাত্ররা দল করুক বা বিএনপি নির্বাচন করুক আর যাই হোক, তারা তো এই কাঠামোর মধ্যেই থাকবে। মনে রাখা দরকার, ব্যবাসায়ীরা কিন্তু এখানে একটি প্রবল শক্তি হিসেবে পরবর্তী কালেও থাকবে। এখানে নির্বাচন হলেও থাকবে। এই শ্রেণিকে তো আর ফেলতে পারছে না। এই শ্রেণি তো ক্ষমতায় আছে। সুতরাং এই শ্রেণির যে উৎপাত, নির্যাতন, ব্যাপক লুটপাট, এটা হয়তো একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারে তারা; কিন্তু এই শ্রেণিকে বাদ দিয়ে, অস্বীকার করে, বিএনপিও চলতে পারবে না, আর ছাত্ররা যে নতুন দল গঠন করবে বলছে তারাও টিকতে পারবে না। জামায়েত ইসলামীও পারবে না। কেউ পারবে না। একভাবে বলা যেতে পারে, এই শক্তিকে সালাম করেই তাদের থাকতে হবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি সম্প্রতি বলেছেন হাসিনা সরকারের পতন ভারত হজম করতে পারেনি। এই হজম না করতে পারার কারণে ভারত কি পাল্টা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে?

বদরুদ্দীন উমর: দেখাতে পারে মানে কি, দেখাচ্ছে এখন। এটা তো কোনো ভবিষ্যতের কথা না। ভারতের সাম্রাজ্যবাদী ঔদ্ধত্য থেকে প্রতিবেশী কোনো দেশ ভালো নেই। পাকিস্তান তো দূরের কথা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা কারও সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো নেই। সবার সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক। আর বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেই তার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। হাসিনা তো তার চাকরানির মতো কাজ করেছে। হাসিনা নরেন্দ্র মোদির চাকরানি ছাড়া আর কিছু ছিল না। কারণ ভারত বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি, আর নরেন্দ্র মোদি যা চেয়েছে, হাসিনা দিয়ে দিয়েছে। শুধু একটি শর্ত হচ্ছে, হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। সে জন্য নরেন্দ্র মোদির ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। কাজেই এই সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াটা বেড়ালের সামনে থেকে মাছ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। বেড়ালের সামনে থেকে মাছ সরিয়ে নিলে বেড়াল রাগ হবে না? কাজেই এ বেড়ালের রাগই আমরা দেখছি এখন। তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে হেয় করতে। তারা বলতে চায়, ওখানকার প্রচারমাধ্যমে এটা প্রচার করছে, হাসিনা একটি নির্বাচিত সরকার, তাকে এভাবে তাড়াল? তাকে এভাবে তো কোনো সামরিক শাসন ক্যু করে তাড়ায়নি। তাকে তো তাড়িয়েছে জনগণ। এমনভাবে লোকজন জেগেছে যে আওয়ামী লীগের লোকজন সব বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এই অবস্থা কেন হলো এটা তো ভারতের পক্ষে স্বীকার করা বা হজম করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য তারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে। হাসিনাকে তো কেউ আশ্রয় দেয়নি। একমাত্র ভারত আশ্রয় দিয়েছে। আমি কোনো দোষারূপ করার জন্য বলছি না, হাসিনাকে মানুষ এমনই ঘৃণা করে যে তাকে কোনো দেশই আশ্রয় দেয়নি। তাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি মানেই তো তাকে পছন্দ করে না, তাকে ঘৃণা করে। সেই অবস্থায় বাধ্য হয়ে ভারত তাকে আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয় দিয়ে ভারত যে খুব ভালো অবস্থায় আছে তা তো না, খুবই অশ্বস্তির মধ্যে আছে।

হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তো বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারবে না। তা সত্ত্বেও হাসিনাকে তারা ওখানে রেখেছে। এবং যখন রেখেছে, মন্দের ভালো হিসেবে তারা হাসিনাকে দিয়ে নানা কথা বলাচ্ছে। এই যে ভারত হজম করতে পারেনি বলে যেটা বলা হচ্ছে, হজম করতে না পারলেও কী হবে, বাংলাদেশ তো আর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। বাংলাদেশ তো হাসিনাকে আবার সিংহাসনে বসিয়ে ভারতের হাতে তুলে দিতে পারে না। এই অবস্থাটা ভারতকে মেনে নিতেই হবে। ভারত এখন যেটা করছে, আমি বলব এটা দূরদর্শিতার লক্ষণ। নরেন্দ্র মোদির মতো ক্রিমিনাল একটি লোক, সে তো মুসলমানদের শত্রু, এবং বাংলাদেশে যেহেতু মুসলমানদের দেশ, সে চেষ্টা করছে এখানে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার। এতে তো ভারতের কোনো লাভ হবে না। অস্থিতিশীল বাংলাদেশ ভারতের জন্য কোনো কাজে আসবে না। বাংলাদেশের স্থিতিশীল অবস্থা ভারতের জন্যও দরকার, যাতে তারা এখানে বিনিয়োগ করতে পারে। ব্যবসা করতে পারে। নানারকম সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। এখানে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ভারতের কোনো লাভ নেই; কিন্তু নরেন্দ্র মোদি তো বাস্তব-জ্ঞানশূন্য হয়ে এখানে নানারকম উৎপাত করছে। তবে এটা বেশিদিন চালাতে পারবে না। কারণ ভারতের প্রশাসনে যারা আছে, তারাও নরেন্দ্র মোদির পক্ষে আছে বলে মনে হয় না। তারা চেষ্টা করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। কাজেই হজম না হলে বদহজম হবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় দিবসকে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয় বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

বদরুদ্দীন উমর: এ বিষয়টি একটু জটিল বটে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস, সে উপলক্ষে লোকটি বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বলেনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা ছিল তারই গৌরব-কীর্তন করেছে। এই লোকটা একটু নিচুস্তরের, এবং একই সঙ্গে আমি বলব তার বুদ্ধিসুদ্ধিও একটু কম। একটু স্থূল টাইপ। তা নাহলে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে সে শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীকে গৌরবান্বিত করতে পারে না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান সম্পর্কে সে অবশ্যই বলতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটি কথা বলতে কী হতো? কিন্তু সে এমনই এক সাম্প্রদায়িক বদমাশ যে এ দেশের জনগণের লড়াইকে সে অস্বীকার করেছে। এটা হয়েছে আওয়ামী লীগের কারণে। আওয়ামী লীগ প্রচার করেছে শেখ মুজিবই নাকি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। এর মতো মিথ্যাচার আর হয় না। কারণ শেখ মুজিব তো ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য বাড়িতে বসে থাকলেন। তারা বলে যে তাকে না কি ধরে নিয়ে এসেছিল। আরে ধরবে তো বটেই। সবাই যেখানে আক্রমণের মুখে পালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তুমি শেখ মুজিব, তুমি শীর্ষ নেতা, তুমি বাড়িতে বসে থাকলে তোমাকে ধরবে না? সেটা কি গ্রেপ্তার না তুমি আত্মসমর্পণ করলে বসে থেকে? তার নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ধসে যাওয়ার কারণে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ধসে যাওয়ার কারণেই না পালাল তারা। শেখ মুজিব পাকিস্তান গেল, সেখানে তারা তাকে খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন কিছু দেয়নি; কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি, যদিও তার পাইপের জন্য এডিনবোর তামাক দিয়েছিল, সে কথা তিনি নিজেই বলেছেন। এই যে কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে দিল না, এর ফলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া তো দূরের কথা, তিনি জানতেনই না যে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ যে হয়েছে এটা তিনি ছাড়া পেয়ে লন্ডনে গিয়ে প্রথমে শুনলেন; কিন্তু তার বেটি বলে যে তিনি নাকি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ছিলেন। আওয়ামী লীগের অন্য কোনো অবলম্বন না থাকার কারণে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি ব্যবহার করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবের ভাবমূর্তির একটি ভূমিকা ছিল এটা ঠিক। ২৫ মার্চের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সব পালিয়েছে, নরেন্দ্র মোদির কথার ভিত্তি হচ্ছে এটা। যারা মুক্তিযুদ্ধ করবে তো দূরের কথা, তার কল্পনাও করেনি।

মুক্তিযুদ্ধ যেসব হয়েছে, ভিয়েতনামে হয়েছে, আলজেরিয়ায় হয়েছে, সেখানকার নেতারা দেশের মধ্যে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছে। আর আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের আগে পালিয়েছে। তাহলে নেতৃত্ব কীভাবে দিবে? তারা তো চুনোপুঁটিসহ পালিয়েছে। সব চলে গেল কলকাতায়। তারা যাওয়ার ফলে দেশের লোক নিরাপত্তার অভাবে পড়ল। তারা যদি না পালাত তাহলে তো দেশের লোকও এত পালাত না। তারা ভাবল যে আওয়ামী তো পালিয়েছে তাহলে আমরাও পালাই। তারা গিয়ে কী করল? তারা গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ধর্না দিল। এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করার দায়িত্ব ইন্দিরা গান্ধীর কাঁধে দিয়ে দিল। এসব সত্য অস্বীকার করার কিছু নাই; কিন্তু এ দেশের মানুষ তো নিজ থেকেই লড়াই করেছিল। যাদের ছেড়ে আওয়ামী লীগ চলে গিয়েছিল তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই লড়াই যদি ভেতরে না করত, তাহলে দেশ স্বাধীন হতো না। এই স্বাধীনতা তো ভারত এনে দেয়নি, আওয়ামী লীগও না। এই দেশের মানুষ যে এই মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিল তার কোনো ভাষ্য তো আওয়ামী লীগের ন্যারেটিভের মধ্যে পাওয়া যাবে না। এটাই নরেন্দ্র মোদিকে একটি সুযোগ করে দিয়েছে এমন কথা বলার জন্য।

১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে যে চুক্তি স্বাক্ষর হলো, সে চুক্তি কারা স্বাক্ষর করেছিল? যদিও জয়েন্ট কমান্ডারের কথা বলেছিল, ভারত আর বাংলাদেশের, কোথায় জয়েন্ট কমান্ডার? সেখানে তো দুটো চেয়ার ছিল। সেখানে দুটো চেয়ারে জগজিৎ সিং অররা আর নিয়াজি বসে সই করেছিল। কোথায় ওসমানি? তিনি তো মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও সর্বাধিনায়ক ছিলেন; কিন্তু চুক্তির সময় তো তিনি সিলেটে। উপ-প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার, তিনি তখন ওখানে একজন দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন পেছনের সারিতে, তাকে একটি চেয়ারও দেয়া হয়নি বসার জন্য। তার থেকে কি বোঝা যায় না এটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি, এ যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারত জিতেছিল? এ কারণেই তো নরেন্দ্র মোদির মতো শয়তান বাংলাদেশকে উহ্য রেখে এ কথা বলতে পেরেছে। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যেমন বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ উহ্য রেখেছিল, নরেন্দ্র মোদিও সেভাবে উহ্য রেখেছে। কাজেই সে যত শয়তানই হোক, তার কথার তো একটি বাস্তব ভিত্তি রয়েছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যাপক দমন-পীড়ন সত্ত্বেও সম্প্রতি তারুণ্যের শক্তিতে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান সফল হলো। এই তরুণদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

বদরুদ্দীন উমর: দমন-পীড়ন করে দুনিয়ার ইতিহাসে কেউ থাকতে পারেনি। এই যে বাংলাদেশের কথা আমরা বলছি, গণঅভ্যুত্থান হলো, হাসিনা পালাল, সিরিয়াতেও তো কয়েক দিন আগে এরকম হলো। সেখানে আসাদের পরিবারের পঞ্চাশ বছর ধরে শাসন করেছে। চরম নির্দয়ভাবে শাসন করেছে। পঞ্চাশ বছরে তারা উৎখাত হয়েছে। অবশ্য তারা যে প্রক্রিয়ায় উৎখাত হয়েছে এবং বাংলাদেশে হাসিনা-সরকার যেভাবে উৎখাত হয়েছে সেই প্রক্রিয়া আলাদা। আসাদ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত হয়নি। সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে উৎখাত হয়েছে। আর এইখানে জনগণ উৎখাত করেছে। এই জনগণ আরো শক্তিশালী। এ কারণে আসাদ-সরকারের অনেকে এখনো দেশে রয়েছে, কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগের ঝাড়শুদ্ধ উজাড় হয়েছে। এতে বোঝা যায় নির্যাতনের যে ব্যারোমিটার, সিরিয়াতে পঞ্চাশ বছরে যত ছিল বাংলাদেশে ১৫ বছরে তার চাইতে অনেক বেশি ছিল। জনগণের প্রতিক্রিয়া থেকে এটা বোঝা যায়। এই যে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হলো তার পেছনে জনগণ ও ছাত্রদের যৌথ উদ্যোগে যে প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তাতে বোঝা যায় মানুষ আছে, মানুষ তো পাথর না, যে সব সময় অন্যায়-অত্যাচার সয়ে যাবে, একদিন সে রুখে দাঁড়াবেই। তবে এই গণঅভ্যুত্থান কোনো সামাজিক বিপ্লব না। খুব বড় ধরনের পরিবর্তন না হলেও কিছু পরিবর্তন হবে। মৌলিক পরিবর্তন না হলেও এই গণঅভ্যুত্থানের একটি স্থায়ী প্রভাব বুর্জোয়া দলগুলোর মধ্যে পড়বে। পরবর্তীতে তারা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারী হতে ভয় পাবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ