ডেঙ্গু: প্রাণ বাঁচাতে চাই সচেতনতা
আবারও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। একটি মশা কীভাবে একজন সুস্থ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় তা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের না দেখলে আমরা হয়তো বুঝতেই পারতাম না। ম্যালেরিয়ার উন্নত চিকিৎসা থাকায় এখন সেরকম মৃত্যু চোখে পড়ে না। ম্যালেরিয়া এখন পাহাড়ি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। আর ডেঙ্গু এখন রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে অন্যান্য শহরাঞ্চল হয়ে গ্রামেও বিস্তৃত হচ্ছে।
একটু পেছনে ফিরে তাকাই। তখন ২০০০ সাল, বাংলাদেশ মশাবাহিত এই রোগটির সঙ্গে তখনো খুব একটা পরিচিত নয়। হাসপাতালে রোগীর ভিড় গ্রীষ্মের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে। জ্বর, রক্তের অণুচক্রিকা কমে যাওয়া এবং রক্ত প্লাজমা নিঃসরণের ফলে মৃত্যুর মিছিলের শুরুটা ঢাকা থেকেই। একে একে মৃত্যু তালিকায় নাম লেখাতে থাকে বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষ। সরকারি হিসেবে সে বছর ৯৩ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তোলপাড় হয় পুরো দেশে। নতুন করে ডেঙ্গু রোগের নাম জানতে পারে মানুষ, যার ভয়াবহতা অনেক। পরের দুই বছর যথাক্রমে ৪৪ ও ৫৮ জনের মৃত্যু হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। এর পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। মানুষও কিছুটা উদাসীন হয়ে পড়ে।
ওই ঘটনার ঠিক ১৮ বছর পর, ২০১৯ সালে দেশে ঝড়ের বেগে দেখা দেয় ডেঙ্গু। তখন আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে, সে বছর সারা দেশে আক্রান্ত হয় ১ লাখের বেশি মানুষ। মৃত্যুর তালিকায় সে বছরই নাম লেখায় ১৭৯ জন মানুষ। প্রতিদিন মৃত মানুষের সংখ্যা জানাতে হতো আমাকেই। শিশু আর প্রিয়জন হারানোর গল্প শুনে প্রতিদিন ভারী চোখ নিয়েই ফিরতে হতো বাসায়। এরপর ২০২৩ সালে ডেঙ্গু নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। ২০২৪ সালেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, প্রাণ যায় ৫৭৫ জনের। এ বছর আবারও বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু গ্রীষ্মকালীন রোগ। এডিস মশার কামড়ে এই রোগ ছড়ায়। সংক্রমণের তিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গায়ে ব্যথা এবং শরীরের চামড়ায় ফুসকুড়ি হলে বুঝে নিতে হবে আপনি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু সেরে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষয়ী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়। অনেক সময় রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ কমে যায়।
কিছু পরীক্ষা করা হয় ডেঙ্গু নিশ্চিত হওয়ার জন্য আর কিছু পরীক্ষা দেয়া হয় ডেঙ্গুর জটিলতা শনাক্ত করার জন্য। ডেঙ্গুর জন্য সাধারণত রক্তের সিবিসি পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, আর ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের জন্য দুই রকমের পরীক্ষা সাধারণত করা হয়। একটি হলো NS1 AG পরীক্ষা, আরেকটি হলো অ্যান্টিবডি পরীক্ষা। জ্বর কমলে বা রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার পর রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে এবং তখনি রক্তক্ষরণসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ কারণে জ্বর চলে যাওয়ার পর রোগীকে সতর্ক থেকে নিয়ম অনুযায়ী চলতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
স্বাভাবিক জ্বর থেকে ডেঙ্গু জ্বরের পার্থক্য টানতে চিকিৎসকরা শুধু শরীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠা লক্ষণগুলোতেই নজর দেন না, কারণ অনেক সময় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর শরীরে লক্ষণ স্পষ্ট হয় না। তাই ডেঙ্গু নির্ণয়ে কিছু টেস্ট করাতে দেন চিকিৎসকরা। ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট হলো NS1 এই টেস্ট জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই করলে টেস্টের রেজাল্ট ভুল আসে। তাই, টেস্টের রিপোর্ট যাতে শতভাগ নির্ভুলের জন্য জ্বরের ২৪ ঘণ্টা থেকে ৩ দিনের মধ্যে এ টেস্ট করতে হবে।
প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী; বছরে তিনবার মশা জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। এবার প্রাক-বর্ষা জরিপ শেষ হওয়ার আগেই ঢাকায় বসতবাড়িতে এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে সতর্ক হওয়ার মতো। মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ক্ষতি কমাতে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি।
ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কীভাবে? এ প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন। এর উত্তর হলো- যেসব স্থানে মশা ডিম পাড়ে বা শূককীট বেড়ে ওঠে সেগুলোকে ধ্বংস করতে হবে। তাই বাড়ির আঙিনা ও ঘরের ভেতরে যে কোনো পাত্রে জমে থাকা পানি তিন দিন অন্তর ফেলে দিতে হবে। নিজে সতর্ক হতে হবে অন্যকে সতর্ক করতে হবে। মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
আয়শা আক্তার: উপপরিচালক, ২৫০-শয্যা টিবি হাসপাতাল, শেরেবাংলানগর, ঢাকা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে