বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের ময়নাতদন্ত
ভুলের খেসারত : সুযোগে সদ্ব্যবহারে ব্যর্থতা
হামজা চৌধুরীর ইংলিশ লিগে খেলার অভিজ্ঞতা আছে, খেলেছেন ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ জাতীয় দলেও। সামিত সোম খেলেন কানাডা লিগে, দেশটির জাতীয় দলে খেলার অভিজ্ঞতাও আছে এ মিডফিল্ডারের। ফাহমিদুল ইসলাম ইতালির নিচু সারির লিগে খেললেও গতি, হার না মানা মানসিকতায় এ ফরোয়ার্ডও সমৃদ্ধ। ফিনল্যান্ডে বেড়ে ওঠা তারিক কাজী তো বাংলাদেশ রক্ষণে আস্থার প্রতীক। উল্লিখিতরা নিজেদের দক্ষতায় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলকে সমৃদ্ধ করেছেন; কিন্তু এ রসদগুলো এক সুতোয় গাঁথার কাজটাই যে হলো না! যা করতে হয় কোচকে।
১০ জুন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে প্রায় ২২ হাজার দর্শক ছিল। হামজা-সামিতদের ঘিরে ছিল দর্শক-সমর্থকদের এ আগ্রহ। সেটা এখনো ফুরিয়ে যায়নি; কিন্তু দর্শক যে প্রত্যাশা নিয়ে মাঠে এলো, সেটা আর পূরণ হলো কই! এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে কেবল একটা ম্যাচ হারেনি বাংলাদেশ, হাতছাড়া করেছে দারুণ একটা সুযোগও। সেটা ছিল দর্শক আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়া, ফুটবল ঘিরে তৈরি হওয়া হাইপ কাজে লাগানোর সুযোগ।
এ পর্যায়ে আপনি যখন ম্যাচ খেলতে নামবেন, জয় কিংবা হার- দুটোর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে দ্বিতীয়টি; কিন্তু আপনার সামনে যখন ফুটবল জাগরণের সুযোগ আসবে, সেটা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। কারণ এমন সুযোগ হরহামেশা আসে না। দীর্ঘদিন পর ফুটবল ঘিরে উন্মাদনা দেখা গেল। সেটা কাজে লাগাতে ভালো নৈপুণ্য প্রদর্শনের প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু সেটা পূরণ করতে পারেনি হাভিয়ের ক্যাবরেরার দল। মোহামেডানকে পেশাদার যুগের প্রথম লিগ শিরোপা জেতানো কোচ আলফাজ আহমেদ কিন্তু সে কথাই বললেন, ‘আপনি যখন সামর্থের সেরাটা দেবেন, ভালো ফুটবল খেলবেন তখন ম্যাচ হারলেও দর্শকরা হতাশা হবেন না। বরং আপনার হয়ে গলা ফাটাবেন।’
হামজা চৌধুরী, সামিত সোম, ফাহমিদুল ইসলাম, তারিক কাজীরা থাকার পরও বাংলাদেশ কি আদৌ সামর্থ্যের সেরাটা দিতে পেরেছে? যারা ম্যাচ দেখেছেন, তারা একবাক্যে বলবেন- না, পারেনি। এ জায়গায় কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরার কৌশল এবং একাদশ নির্বাচন কিন্তু প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকছে না। একাদশ নিয়ে প্রশ্ন থাকছে আগের ম্যাচে উজ্জ্বল জামাল ভূঁইয়াকে না নেয়ায়। শাকিল আহাদ তপুকে একাদশে রাখলেও বাংলাদেশের স্প্যানিশ কোচ এ ডিফেন্ডারকে খেলালেন রাইটব্যাক পজিশনে। যেটা ১৯ বছর বয়সি ফুটবলারের ন্যাচারাল পজিশন নয়। সেন্টারব্যাক তপুকে রাইটব্যাক হিসেবে খেলানোয় রক্ষণের কাজটা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু আক্রমণে রসদ জোগানোর কাজটা ছিল অনুপস্থিত।
রাইটব্যাক এবং লেফটব্যাক পজিশনে যারা খেলেন তাদের কাজ কেবল প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করা না; দলের আক্রমণে রসদ জোগানোও। যার অন্যতম দুই উইং থেকে গোলমুখে ক্রস ফেলা। রাইটব্যাক পজিশন থেকে সে ক্রসগুলো পায়নি বাংলাদেশ। তারপরও শাকিল আহাদ তপুকে ৭৬ মিনিট খেলিয়ে গেছেন বাংলাদেশ কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরা। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে এ পজিশনে তাজ উদ্দিনই ছিল প্রত্যাশিত; যিনি ৪ জুন ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচে রক্ষণের পাশাপাশি দলের আক্রমণে রসদ জুগিয়েছেন। ভুটান ম্যাচে বক্স টু বক্স খেলা জামাল ভূঁইয়াও ছিলেন উজ্জ্বল; কিন্তু এ মিডফিল্ডারকে বেঞ্চে রেখে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে খেলানো হয় সৈয়দ কাজেম শাহকে।
টিম সিলেকশন, প্লেয়ার পজিশনিং ছাড়াও কৌশলগত নানা ত্রুটিও ছিল ম্যাচে। ঘরের মাঠের এ ম্যাচে বাংলাদেশ অলআউট ফুটবল খেলেছে ০-২ গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর। সেটা আরও আগেই চেষ্টা করা উচিত ছিল। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আলফাজ আহমেদও সেটাই মনে করছেন। ম্যাচের আগে সিঙ্গাপুর যে বাংলাদেশকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছে, সেটা কিক-অফের পরই পরিষ্কার হয়। অতিথি দল শুরুতেই মাঝমাঠের লাগাম টেনে ধরেছিল। বলাবাহুল্য, বর্তমান বাংলাদেশ দলের প্রাণ তো মাঝমাঠই। যেখানে হামজা চৌধুরী, সামিত সোম, জামাল ভূঁইয়া, মোহাম্মদ হৃদয়, সোহেল রানার মতো খেলোয়াড় খেলেন। প্রতিপক্ষ দলের কৌশলের বিপরীতে মাঝমাঠের দখল নেয়ার পাল্টা কৌশল দেখা যায়নি হাভিয়ের ক্যাবরেরাকে।
প্রতিপক্ষ দল যখন মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করবে, স্বাভাবিকভাবেই চাপ পরবে আপনার রক্ষণে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছিল। বাড়তি চাপ সামাল দিতে ম্যাচের বিভিন্ন অংশে হামজা চৌধুরী রাইটব্যাক পজিশনে নেমে এসে শাকিল আহাদ তপুকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনে ঠেলে দিচ্ছিলেন! সাম্প্রতিক সময়ে চ্যাম্পিয়নশিপে শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে রাইটব্যাক হিসেবেই খেলতে দেখা গেছে হামজা চৌধুরীকে। হয়তো এ কারণেই ওই পজিশনে নেমে গিয়েছিলেন ২৭ বছর বয়সি মিডফিল্ডার। কোন পরিস্থিতিতে কোন কৌশল নিতে হবে- এটা ঠিক করা কোচের কাজ। ম্যাচের নানা অসঙ্গতির কারণে ফুটবল বিশ্লেষকরা হাভিয়ের ক্যাবরেরাকে তাই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন।
এখানে বাংলাদেশ কোচকে দুর্ভাগাও বলছেন সাবেক স্ট্রাইকার আলফাজ আহমেদ, ‘কোচের দুর্ভাগ্যই বলব। কারণ তার হাতে আক্রমণভাগের এমন ফুটবলার ছিল না, যারা প্রতিপক্ষের গোলমুখে গিয়ে বল নিজেদের হোল্ড পারেন। সেটা করা গেলে আক্রমণে অন্যরা এগিয়ে আসার সুযোগ পেতেন; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রতিপক্ষের গোলমুখে যিনি বল ধরেছেন, তিনি একা। বল ধরে হোল্ড করতে পারলে অন্যরা আক্রমণে যোগ দিতে পারেন।’ ফয়সাল আহমেদ ফাহিম মাঠে আসার পর বাংলাদেশের আক্রমণের গতি বেড়েছে। বসুন্ধরা কিংসের ফরোয়ার্ডকে আরও আগে পাঠানো উচিত ছিল বলেও মনে করা হচ্ছে।
আধুনিক ফুটবলে একজন ভুল করলে তা ঢেকে দিতে অন্যরা দ্রুত এগিয়ে আসেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটা খুব একটা দেখা যায় না। এ কারণে নির্দিষ্ট ফুটবলার ভুল করে বসলে তার খেসারত দিতে হয় দলকে। দিতে হলো সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচেও। যে মুভ থেকে অতিথি দল প্রথম গোলটা করেছে, সেখানে একসঙ্গে চার-পাঁচটা ভুল ছিল। আন্তর্জাতিক ফুটবলে আপনি এমন ভুল করলে তার মাশুল দিতে হবে ষোল আনা, মাশুল দিতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকেও।
গোলের উৎস ছিল হারহাইস স্টুয়ার্ডের থ্রো-ইন। বক্সের মধ্যে ফেলা লম্বা থ্রো-ইন পুরোপুরি ক্লিয়ার করতে পারেননি সাদ উদ্দিন। এ লেফটব্যাকের হাফ-ক্লিয়ারেন্সকে বিপদমুক্ত করার জন্য সামনে কেউ ছিল না। বক্সের বাইরে সিঙ্গাপুর অধিনায়ক হারিস হারুন ছিলেন আনমার্কড। তার শট তারিক কাজীর পায়ে লেগে হাওয়ায় ভাসছিল। ক্লিয়ার করতে এগিয়ে আসেন গোলরক্ষক মিতুল মারমা। এ কাস্টডিয়ানের প্রচেষ্টাও ছিল হাফ ক্লিয়ারেন্স। পরবর্তীতে হারহাইস স্টুয়ার্ড বিনা বাধায় গোলমুখে বল ফেলেন- যা থেকে গোল করে সিঙ্গাপুর।
আপনি ভুল করলেন, দল তার মাশুল দিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা যখন ভুল করে, তার সুফল তুলতে না পারলে দল তো ডুববেই। সিঙ্গাপুরের গোলরক্ষক ইজওয়ান মাহবুদের একটা ভুল ছিল ম্যাচের ষষ্ঠ মিনিটে। ৩ জনের বিরুদ্ধে তিনজন থাকা অবস্থায় এ গোলরক্ষক ভুল পাসে বল দিয়েছিলেন সামিত সোমের পায়ে। কানাডা প্রবাসি মিডফিল্ডারের সামনে তখন ফাহমিদুল ও রাকিব হোসেন। বক্সের মধ্যে রাকিব ছিলেন অনসাইড এবং আনমার্কড। ওই অবস্থায় বক্সের সামান্য বাইরে সামিত সোম বলটা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি- বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের মাথায় হাত, মাথায় হাত ছিল গ্যালারিতে থাকা দর্শকদেরও!
আধুনিক ফুটবল প্রতিপক্ষ দল আপনাকে এমন সুযোগ খুব কমই দেবে। সুযোগ পাওয়ার পর সেটা কাজে লাগাতে না পারলে আপনি পিছিয়ে যাবেন। সিঙ্গাপুরের কাছে হেরে বাংলাদেশ এশিয়ান কাপে নাম লেখানোর দৌড়ে পিছিয়ে গেল। ভারতের সঙ্গে ড্র, সিঙ্গাপুরের কাছে হার- দুই ম্যাচে লাল-সবুজদের সংগ্রহ ১ পয়েন্ট। গ্রুপের লাগাম এখন সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের হাতে। দেশ দুটির সংগ্রহ সমান, ৪ পয়েন্ট করে। ভারতের সমান, ১ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ আছে গ্রুপের তৃতীয় স্থানে।
ম্যাচে দুর্ভাগ্যও ভর করেছিল বাংলাদেশের ওপর। ২১তম মিনিটে ফাহমিদুল ইসলামের প্রেসিংয়ে সিঙ্গাপুর ডিফেন্ডার আমিরুল আদলির ব্যাকপাস গোলরক্ষক ইজওয়ান মাহবুদ গ্রিপে নিলেও রেফারি ক্লিফর্ড দায়পুইয়াত ফাউলের সিদ্ধান্ত দেননি। ফাহমিদুল ইসলামের জোড়ালো আবেদনও উপেক্ষা করলেন ফিলিপাইনের এ রেফারি। এ ধরনের ক্ষেত্রে বক্সের মধ্যে ফ্রি-কিক দেয়ার বিধান আছে, প্রদর্শন করা হতে পারে কার্ডও। ম্যাচের শেষদিকে ফয়সাল আহমেদ ফাহিমকে সিঙ্গাপুরের মিডফিল্ডার ইরফান নাজিব যেভাবে ট্যাকল করেন, সেটা ছিল পরিষ্কার পেনাল্টি। এ যাত্রায়ও রেফারি সেটা এড়িয়ে গেছেন।
ভুল কি কেবল মাঠের খেলায় ছিল? ভুল ছিল মাঠের বাইরেও। ম্যাচ ঘিরে তৈরি হওয়া হাইপে উপেক্ষিত ছিলেন বাংলাদেশি আলট্রাস এবং বাংলাদেশ ফুটবল সাপোর্টার্স ফোরামের মতো সক্রিয় সমর্থকদের জোট। ফ্রি-পাস পাওয়া যাবে না জানার পর সমর্থক জোট সদস্যরা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছিলেন, টিকিট কেনার সুযোগ করে দিতে; কিন্তু উপেক্ষিত ছিলেন বিগত দিনে লাল-সবুজদের হয়ে গলা ফাটানো দুই জোটের সদস্যরা। ফুটবলের দুর্দিনে যারা গ্যালারি মাতিয়ে গেলেন, সুসময়ে ফেরার লক্ষণ ফুটে ওঠার সময়ে তারাই উপেক্ষিত!
ম্যাচে মর্যাদা দেয়া হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাবেক ফুটবলাররা। পশ্চিম পাশের গ্যালারির নিচের দিকে খেলা দেখছিলেন সাবেক তারকা রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির, আলফাজ আহমেদরা। সাধারণ গ্যালারিতে দর্শকদের সঙ্গে হট্টগোলে জড়াতে দেখা গেছে সাব্বিরের মতো তারকাকে। ফুটবলের ঘনিষ্ঠরাই যেখানে মূল্যায়িত হননি, সেখানে বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন কর্মকর্তা তো হিসেবের মধ্যেই আসেনি। অথচ বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানোর বন্ধুত্বপূর্ণ অতীত আছে বাংলাদেশ ফুটবলে। বলা হচ্ছে ফুটবল ঘিরে তৈরি হওয়া আগ্রহের কারণে বাফুফে কর্মকর্তারা ‘হাতির পাঁচ পা দেখছেন’! ওই অবস্থা থেকে বাস্তবতার জমিনে ফেরা জরুরি। নইলে অতীতের মতো পথ হারাতে কিন্তু সময় লাগবে না।
একদিকে ভুল কৌশল ও টিম সিলেকশন অন্যদিকে ম্যাচের বিভিন্ন অংশে নিজেদের ভুল, আছে প্রতিপক্ষের ভুলের সুযোগ নিতে না পারার ব্যর্থতাও- এমন ম্যাচে যা হবার তাই হলো ১০ জুন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে। বাছাই পরীক্ষায় অক্টোবরে আবারও মাঠে নামবে লাল-সবুজরা। ঘরের মাঠের পর অ্যাওয়ে- দুই ম্যাচে প্রতিপক্ষ হংকং। সে ম্যাচে পেছনের ভুলের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাইবে না দর্শকরা। একই ভালো বারবার হলে ফুটবলমোদীরা কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।
মাহবুব সরকার: সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে