Views Bangladesh Logo

সম্ভাবনার দাবা, হতাশার দাবা!

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

র্জিয়ার বাটুমিতে দিব্যা দেশমুখ উদীয়মান অনেক ভারতীয় দাবাড়ুর স্বপ্নের বীজ বপন করলেন। ১৯ বছর বয়সে প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে জিতলে বিশ্ব দাবা সংস্থা (ফিদে) ওয়ার্ল্ড কাপ। মহারাষ্ট্রের নাগাপুরে জন্ম নেওয়া এ দাবাড়ু বিশ্বকাপের সঙ্গে গ্র্যান্ডমাস্টার (জিএম) খেতাবও পেলেন। এ নিয়ে চতুর্থ নারী জিএম পেল ভারত। নারী পুরুষ মিলিয়ে সংখ্যাটা ৮৮। দেশটি প্রথম জিএম পেয়েছিল ১৯৮৮ সালে। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথান আনন্দকে দিয়ে দাবার এলিট ক্লাবে পথচলা শুরু। ২০১৮ সালে জিএম সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে এসে ৮৮ জনে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ সর্বশেষ গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছে আজ থেকে ১৭ বছর আগে, ২০০৮ সালে। একটা সময় পিছিয়ে থাকা ভারতের উত্থানের বিপরীতে বিস্ময়করভাবে নিচে নেমেছে বাংলাদেশের দাবা। কী কারণে উল্টারথে চলা?

বাংলাদেশের অন্যতম আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) এবং দাবা কোচ আবু সুফিয়ান শাকিল বাংলাদেশ দাবা পিছিয়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বললেন, ‘দাবা উন্নয়নে কেবল বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এ জন্য সরকার, দাবা ফেডারেশন এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে দলগত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে তেমন প্রচেষ্টা কখনোই দেখা যায়নি।’ ১৯৮৭ সালে নিয়াজ মোর্শেদ যখন জিএম খেতাব লাভ করেন, তখন কেবল ভারত নয়; উপমহাদেশ কোনো জিএম দেখেনি। পরের বছর প্রথম জিএম পাওয়া ভারত খেলাটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে; যার সুফল দিব্যা দেশমুখের মতো বিশ্বজয়ীরা!

একটা সময় দাবা ছিল দারুণ সম্ভাবনাময় খেলা। বাটার পৃষ্ঠপোষকতায় স্কুল দাবা প্রতিযোগিতা দেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। আজকের প্রতিষ্ঠিত অনেক দাবাড়ু উঠে আসেন বাটা স্কুল দাবা প্রতিযোগিতা দিয়ে। দীর্ঘদিন স্কুল দাবায় পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রতিষ্ঠানটি দাবা ছেড়ে গেলেও স্কুল প্রতিযোগিতা আয়োজনে এগিয়ে এসেছিল আরেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। একটা সময় এ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানও দাবা ছেড়ে যায়। ছেড়ে যায় বললে ভুল হবে, বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন প্রতিষ্ঠানটিকে ধরে রাখতে পারেনি। এভাবে একের পর এক বন্ধু হারিয়েছে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক পরিবর্তন আসে। বাটা ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের দাবা ছেড়ে যাওয়া সে প্রক্রিয়ারেই অংশ। প্রতিষ্ঠানগুলো দাবা ছেড়ে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে দাবাড়ু ও খেলাটির বিচারক মোহাম্মদ শামীম বলছিলেন, ‘প্রতিটি জাতীয় ফেডারেশন কিন্তু একেকটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং একটি কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করবে। কিন্তু বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন তেমন প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি। বরং এখানে কাজ হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যে কারণে এখানে সমন্বিত কাজও সেভাবে দেখা যায়নি।’ মোহাম্মদ শামীমের এ কথার সঙ্গে আবু সুফিয়ান শাকিল যোগ করলেন, ‘অতীতে বিভিন্ন ব্যক্তি দাবার নেতৃত্বে ছিলেন, যারা খেলাটির আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। সে অর্থ ব্যবহার করে পরিকল্পনা সাজানো এবং মাঠ পর্যায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো দক্ষ লোকবলের অভাব কিন্তু সবসময়ই ছিল। দেখা গেছে, যিনি দাবার জন্য অর্থ আহরণ করছেন; তিনিই পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন আবার মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের কাজও করছেন। ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তি সরে যাওয়ার পর শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এভাবে সময়ের সঙ্গে পিছিয়েছে বাংলাদেশের দাবা।’

এ খেলার অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে, একটি সময় জোটবদ্ধ খেলোয়াড়রাই বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের নির্বাচনের মাঠে নেমেছিলেন। ২০১২ সালের সে নির্বাচনের লড়াইয়ে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক ফোরামের আশীর্বাদ পুষ্ট ছিল ‘খেলোয়াড়-সংগঠক ঐক্য পরিষদ’। অন্যদিকে দাবাড়ুদের জোটের নাম ছিল ‘খেলোয়াড় ঐক্য পরিষদ’। নিয়াজ মোর্শেদ, খন্দকার কায়েস হাসান, তনিমা পারভিনের মতো দাবাড়ুদের নিয়ে জোটবদ্ধ হওয়া ‘খেলোয়াড় ঐক্য পরিষদ’ ভোটের লড়াইয়ে হেরে যায়। ২৪ পদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল ক্রীড়াঙ্গনের বিষফোড়া নামে পরিচিত ফোরামের আশীর্বাদপুষ্ট জোট খেলোয়াড়-সংগঠক ঐক্য পরিষদের।

২০১২ সালের ওই নির্বাচন দিয়েই বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন ফোরামে কবজায় চলে গেছে। গাজী সাইফুল তারেক খেলোয়াড় ঐক্য পরিষদের বিপক্ষে নির্বাচন করে সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন ফোরামের সমর্থন নিয়ে। পরে একই কায়দায় সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম এ পদে বসেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দুজনকে নিয়েই সমালোচনা হয়েছে। ফোরামের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা গেছে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে অ্যাডহক কমিটি গঠনের মাধ্যমে; কিন্তু এ কমিটির দায়িত্ব গ্রহণের পর হতাশার অধ্যায় দ্রুত বড় হতে থাকে। কমিটি গঠনের পর মাত্র কয়েক মাসের কার্যক্রম দিয়ে দাবায় উল্টো পথে হাঁটার চিত্রটা স্পষ্ট হয়েছে, যা বিগত কমিটিগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

পৃষ্ঠপোষক নেই, এ কারণে ঘরোয়া অনেক প্রতিযোগিতায় নেই অর্থ পুরস্কারও। যেখানে অর্থের হাতছানি নেই, সেখানে আগ্রহ কমবে- এটাই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেক দাবাড়ু। অর্থ ছাড়াও আগ্রহ ধরে রাখা যেত, যদি দাবাড়ুদের বিদেশি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া যেত। এ জায়গায়ও ইতিবাচক কিছু করতে পারছেন না বর্তমান দাবা নিয়ন্তারা। লন্ডনে ১০ থেকে ১৬ জুন ওয়ার্ল্ড র‍্যাপিড অ্যান্ড ব্লিটজ টিম চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য বাংলাদেশ নিবন্ধন করলেও শেষপর্যন্ত দল পাঠাতে পারেনি। সম্প্রতি বেশ আলোচিত ছিল বিশ্ব স্কুল দাবা টিম চ্যাম্পিয়নশিপে দল পাঠাতে না পারার বিষয়টি। এ নিয়ে খোদ দাবাড়ুরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ নিংড়ে দিয়েছেন।

এ প্রতিযোগিতায় দল না পাঠানোর কারণে দাবা সংশ্লিষ্টদের ক্ষোভ এবং হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারার কারণে। দেশে আয়োজিত জাতীয় স্কুল দলগত দাবা প্রতিযোগিতায় কোনো অর্থ পুরস্কার ছিল না। আয়োজক বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন ঘোষণা দিয়েছিল, জাতীয় স্কুল দলগত দাবা প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন দলকে বিশ্ব স্কুল দাবা টিম চ্যাম্পিয়নশিপে পাঠানো হবে। ঘরোয়া স্কুল প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্ব আসরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে সাউথ পয়েন্ট স্কুল। রায়ান রশীদ মুগ্ধ, সিয়াম চৌধুরী, ওয়ারসিয়া খুশবু, সাফায়ত কিবরিয়া আযান এবং নিলাভা চৌধুরীর মতো প্রতিশ্রুতিশীল দাবাড়ুদের নিয়ে গড়া হয়েছিল সাউথ পয়েন্ট দল। বিশ্ব আসরে অংশগ্রহণ করতে না পারায় দলের সদস্যরা হতাশ। এ নিয়ে বিরক্ত দাবা সংশ্লিষ্টরাও।

সিয়াম চৌধুরী এবং ওয়ারসিয়া খুশবু এ-সংক্রান্ত ক্ষোভ নিংড়ে দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। যেখানে সরব হয়েছিলেন কিংবদন্তি দাবাড়ু রানী হামিদ। বর্তমান অ্যাডহক কমিটি গঠনের পর থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশ এবং উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ ও রানী হামিদ। বিশ্ব স্কুল দাবা দলগত চ্যাম্পিয়নশিপ-সংক্রান্ত ওয়ারসিয়া খুশবুর ফেসবুক পোস্টের কমেন্ট বক্সে রানী হামিদ লিখেছেন, ‘নিজেদেরই বলতে হবে, আওয়াজ উঠাতে হবে, অনেক বলা হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। এটা আমাদের দাবার জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’

ঘরে-বাইরের নানা দাবা কার্যক্রম নিয়ে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন খেলাটির বিশেষজ্ঞরা। এটা না করা হলে খেলাটি আরও পিছিয়ে যাবে, খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এবং খেলা সংশ্লিষ্টদের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কাও করা হচ্ছে। অতীতে বিভিন্ন সময় দাবা ফেডারেশনে খেলোয়াড়দের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব চেস প্লেয়ার্স বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ বেশ সরব ছিল; কিন্তু দাবাড়ুদের এ সংগঠনের নেতৃত্ব স্থানীয়রা এখন রহস্যময় কারণে নীরব- এমন অভিযোগ দাবাড়ুদের। এ নিয়েও বাড়ছে ক্ষোভ।

ফাহাদ রহমান, মনন রেজা নীড়, তাহসিন তাজওয়ার জিয়া, সাকলাইন মোস্তফা সাজিদ, স্বর্ণাভো চৌধুরী, ওয়ারসিয়া খুশবো, ওয়াদিফা আহমেদ, নীলাভা চৌধুরীর মতো উদীয়মান ও প্রতিভাবান দাবাড়ুর জন্য প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা; কিন্তু বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন আদৌ সেটা নিশ্চিত করতে পারছে!

বাংলাদেশের জিএম সংখ্যা পাঁচ; কিন্তু জিয়াউর রহমান দুনিয়া ছেড়ে গেছেন। বাকি চারজনও নিয়মিত কার্যক্রমে সচল নন। সব মিলিয়ে দাবার চলমান ছন্নছাড়া অবস্থা উদীয়মানদের ভালো বার্তা দিতে পারছে না। ফাহাদ রহমান, মনন রেজা নীড়, তাহসিন তাজওয়ার জিয়া, সাকলাইন মোস্তফা সাজিদরা প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর নিজেদের মতো করে লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। সে লড়াইয়ে সফল হলে বাংলাদেশের টাইটেলধারীর সংখ্যা হয়তো বৃদ্ধি পাবে; কিন্তু দাবায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি কি আদৌ আসবে- যেমনটি চান খেলা সংশ্লিষ্টরা!

মাহবুব সরকার: লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ