Views Bangladesh Logo

বাজেটে এসএমই উদ্যোগ প্রসারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেশি হতে পারত

ছোট এবং ছিমছাম বাজেট দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা যতটা সফল হয়েছেন এসএমই উদ্যোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে ততটা নয়, যাও বা বলা হয়েছে তার ভাষা এতটাই কঠিন যে এটা বুঝে এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা হয়তো খুব বেশি উপকৃত হতে পারবেন না। এ ছাড়াও নতুন কিছু কর আরোপের মাধ্যমে এ ক্ষুদ্র উদ্যোগ স্থিমিত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ দীর্ঘদিন থেকে বাড়ছে না। এসব নীতিমালা বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে আরও দুর্বল করতে পারে। বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বাজেটে একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ফান্ড স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, বেশ কিছু প্রকল্প বাদ দেয়া হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় বিবেচ্য প্রকল্প মূল্যায়নে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে যা এর গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়েই করার পরিকল্পনা হয়েছে; কিন্তু এসএমই যেহেতু আমাদের মূল জীবনীশক্তি তাই এর প্রতি আলাদা যত্ন দরকার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপিতে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রেখেছে এবং এ ক্ষেত্রে আগামী তিন বছরে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির কথা বাজেটে বলা হয়েছে। এসএমই এবং মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ বিতরণ সুবিধা বাড়ানো এবং তাদের জন্য ডাটাবেজ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির কথাও বলা হয়েছে। কর প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়ের কথা বললেও বাস্তবে তা দেখা যায়নি।

বাজেটে প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের পণ্যের ওপর উৎপাদন পর্যায়ে মূসক ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কটন সুতা উৎপাদন পর্যায়ে কর হার প্রতি কেজি ৩ টাকার পরিবর্তে ৫ টাকা এবং কৃত্রিম আঁশ বা ম্যান মেইড ফাইবার এবং অন্যান্য আঁশের মিশ্রণে তৈরি সুতার ক্ষেত্রেও উৎপাদন পর্যায়ে কর হার ৩ টাকার পরিবর্তে ৫ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ব্লেড উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।

এটা সত্যি কথা যে, উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট না বাড়ালে সরকার রাজস্ব পাবে কোথা থেকে। বাংলাদেশে সার্বজনীন ভ্যাটের উচ্চ হার এবং ট্যাক্স অন ট্যাক্স রয়েছে, কর ক্রেডিট নেয়ার যে সুবিধা ভ্যাটের ক্ষেত্রে সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য সেটা বাংলাদেশে এখনো তেমনভাবে কার্যকর নয়। বিভিন্ন ভ্যাট হার রয়েছে এবং ১৫ শতাংশ হারে সর্বোচ্চ কর হার কমপ্লাই করলেই কেবল ভ্যাট ক্রেডিট নেয়া যায় কাজেই অন্যান্য হারে প্রযোজ্য ভ্যাট রেয়াত নেয়ার সুযোগ নেই।

প্লাস্টিক খাতের ওপর বাড়তি করের বোঝা বহন করতে হবে ভোক্তাকে, এ পণ্যের বেশিরভাগ বিক্রয় হয়ে থাকে গ্রামগঞ্জে এবং সেটা হয় ইনফরমালি যেখানে ভ্যাট ক্রেডিট নেয়ার তেমন সুযোগ নেই। এ ছাড়া প্লাস্টিক খাতের যেসব পণ্যের কথা বলা হয়েছে তা মূলত দরিদ্র ক্রেতাদের ব্যবহৃত পণ্য, এগুলোর দামের বৃদ্ধিতে বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার যে প্রত্যয়ের কথা বলা হয়েছে তার অনেকটাই হয়তো সফল হবে না।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে আগাম করের হার ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে তবে বাণিজ্যিক আমদানিকারকের ক্ষেত্রে আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। এসএমই উদ্যোক্তা মূলত বাণিজ্যিক আমদানিকারকের কাছ থেকে কাঁচামাল ক্রয় করে এবং ক্রেডিট নিতে পারে না, এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।

বাজেটের ধারা ১২২-এ মূল্য সংযোজন আইন, ২০১২-এর ক্ষেত্রে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যে, বাণিজ্যিক আমদানিকারকের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ৫০ শতাংশের বেশি না হলে ব্যবসায়ী পর্যায়ে ফাইনাল সেটেলমেন্ট করে ভ্যাট আরোপের বিধান না করা। সাধারণত বাণিজ্যিক পর্যায়ে ২০ শতাংশের বেশি মূল্য সংযোজন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর একটি বিষয় হলো ১৫ শতাংশের কম হারে ভ্যাট ক্রেডিট নেয়ার সুযোগও নেই, কাজেই এখানে ভ্যাট ক্রেডিট নেয়ার বিষয়টি আর থাকছেই না- সেখানে আইনের ভাষা এতটা জটিল করে ক্ষুদ্র উদোক্তাকে ভারাক্রান্ত করা হয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল বাজেটে ৬২টি মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের জন্য ৭.৯৭ ট্রিলিয়ন টাকার বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১০টি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বা খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের। উল্লেখ্য, বিগত ২০২২-২৩ (৩.৩৭ শতাংশ) থেকে কৃষির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে, ২০২৩-২৪ এটি দাঁড়ায় ৩.৩০ শতাংশ এবং এ বছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১.৭৯ শতাংশ যা খুবই আশঙ্কাজনক। এ ব্যাপারে বাজেটে অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে আমদানি করে এ অবস্থা সামলানো গিয়েছে বলে জানানো হয়েছে তবে এ ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষির ভূমিকা অনেক বড়, এ ছাড়া একটি ব্যাপকসংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এ খাতের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত। বাজেটে কৃষি পণ্য প্রস্তুতকারী উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি, এদের একটি অংশ আমাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ছিল, এখানে নন-ট্যারিফ বাধা কাটিয়ে এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কীভাবে তাদের উদ্যোগ পরিচালনা করবেন সে ব্যাপারে বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই।

কিছু ক্ষুদ্র এসএমই উদ্যোক্তা অনলাইনে তাদের বিক্রয় কার্যক্রম চালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন; কিন্তু অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে একবারে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, এসব খুদ্র উদ্যোক্তা একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়বে।

এ ছাড়াও ৯ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভ্যাট রেয়াতসীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে হ্রাস করে ৩০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়াও টার্ন ওভার ট্যাক্স অর্থাৎ যারা ভ্যাট ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ দিতেন তাদের জন্য এর পরিমাণ পূর্বের ৩ কোটি টাকা থেকে হ্রাস করে ৫০ লাখ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব পরিবর্তনই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নিরাশার কারণ।

তবে বাজেটে বন্ড ব্যবস্থাকে সহজীকরণের এবং ব্যবসাবান্ধব করার জন্য সেন্টারল বন্ডেড ওয়্যারহাউস করার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে খুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেক সমস্যা সমাধান হতে পারে।

অন্যদিকে বাজেটে স্টার্ট-আপদের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিলের কথা বলা হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন হলে অনেক নতুন স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তা তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। তবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি রিফাইন্যান্সিং স্টার্ট-আপ ফান্ড তৈরি হয়ে আছে যেখানে তফসিলি ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফার মাত্র ১ শতাংশ পরবর্তী পাঁচ বছর কন্ট্রিবিউট করবে বলে বলা হয়েছিল, সেটির বাস্তবায়ন তেমন হয়নি দেখা যায়। ২০২০ সালে স্থাপিত এ ফান্ডের মাত্র ৩৫ কোটি ব্যবহৃত হয়েছে, এটি কেন ব্যবহার হচ্ছে না তার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। তা না হলে নতুন ফান্ডের ঘোষণা দিয়ে কোনো লাভ নেই।

এ ছাড়াও বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড কোম্পানি তাদের মুনাফা রিপাট্রিয়েট করতেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। এ কারণে প্রায় ৯০ শতাংশ রেজিস্টার্ড কোম্পানি যারা বিদেশি ফান্ড এখানে নিয়ে আসতে চান তারা বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড না হয়ে বরং সিঙ্গাপুরকে বেশি পছন্দ করে।

সরকার মিনিমাম করের আওতা বাড়িয়েছে, নতুন ৪০টি ধারা (খসড়া ফাইন্যান্স অ্যাক্ট ২০২৫ ধারা ১৬৩) এতে যুক্ত হয়েছে। এটি এমন একটি কর যা মুনাফা বা ক্ষতি নির্বিশেষে প্রদেয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমদানিকৃত পণ্যের জন্য আরোপিত এ কর সমন্বয় করা যাবে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন হারে প্রদেয় এসব কর বিশেষ করে বেভারেজ পণ্যের ওপর প্রযোজ্য কর ৩ শতাংশ হারে নির্ধারিত আছে। অন্যদিকে সিগারেট, বিড়ির ক্ষেত্রে এ হার গ্রস প্রাপ্তির ১ শতাংশ। বেভারেজ পণ্যের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্কও প্রযোজ্য আছে। স্বাস্থ্যগত কারণে এ খাতে করের হার বেশি। এ খাতটি এসএমই নয়; কিন্তু প্রকৃত মোট করের হার অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি। এবারের বাজেটে সব ধরনের আইসক্রিমের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশের স্থলে ৫ শতাংশ নির্ধারিত করেছেন।

অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, বিস্কুট এবং পাউরুটির ওপর ভ্যাট বাড়বে না। অর্থাৎ সরকার একদিকে মিষ্টিজাতীয় খাদ্য তরুণদের জন্য নিরুৎসাহিত করতে চান সেজন্য বেভারেজ পণ্যের ওপর মিনিমাম কর এবং সম্পূরক কর বাড়িয়েছেন। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের খাদ্য বিস্কুট পাউরুটির ওপর কর হার বাড়াতে চান না, কারণ এটা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাবার। আবার আইসক্রিমের ওপর কর হার হ্রাস করেছেন। এ ধরনের নীতির ক্ষেত্রে কিছুটা সামঞ্জস্য দরকার।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি আমাদের অর্থনৈতিক এজেন্ডার মূল বিষয়- এ দুটো দিকেই বাজেটের নজর এবং দৃষ্টিভঙ্গি আরও সুদৃঢ় করা দরকার। এসএমই কর্মসংস্থানের একটি বড় জায়গা, এখানে কর ব্যবস্থা এমনভাবে নমনীয় করা দরকার যাতে দেশে অনেক নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতে পারে।

ফেরদৌস আরা বেগম: অর্থনীতিবিদ ও প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ