বাজেট ২০২৫-২৬: বেসরকারি বিনিয়োগের স্থায়িত্ব নিয়ে কিছু প্রশ্ন
জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং ৮ শতাংশ হারে নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি অর্জনের লক্ষ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত সংকুচিত বাজেট প্রায় ৭ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন টাকা প্রণয়ন করা হয়েছে। ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বিবেচনায় নিয়ে একটি ভাসমান বিনিময় হার ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের বাজেটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, কোনো কোনো পণ্যে বিদ্যমান ভ্যাট কিছুটা কমিয়ে ২০৩০ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ বর্তমানে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের কালপর্বে রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ কৃষিতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে (৩ দশমিক ৩০ থেকে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ), বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত কমে এসেছে (২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ), টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক নীতি আরোপের আশঙ্কার কারণেও প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে। তা ছাড়া প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাধার জন্যও দেশটির অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আছে।
বাজেটে বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো (বিএসডব্লিউ) চালু এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওয়ান স্টপ সার্ভিসের (ওএসএস) প্রদত্ত সেবাগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিনিয়োগ বিনিয়োগ প্রচার সংস্থা ( আইপিএ ) এখনো পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রত্যাশিত আস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এবারের বাজেটে বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো হলো নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব। সম্প্রতি আমরা দেখেছি গ্যাসের অভাবে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ঠিক মতো চলতে পারছে না। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাজেটে ইউটিলিটি খাতের মূল্য বৃদ্ধি না করার কথা বলা হলেও, সরবরাহের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট কথা বলা হয়নি। এসব ছাড়াও বিনিয়োগকারীদের জন্য রয়েছে আরো কিছু প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে আছে উচ্চ সুদের হার, ব্যাংক ঋণের অনিশ্চয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। এসব বিনিয়োগকারীকে নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করেছে। উদ্যোক্তারা আশা করেছিলেন বাজেটে এসব সমস্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা দেখবেন। এরকম কোনো দৃঢ় অবস্থান না দেখে তারা যারপরনাই হতাশ হয়েছেন।
বাজেটে আমদানিকারকদের জন্য অগ্রিম কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, বেশিরভাগ এসএমই তাদের কাঁচামাল বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের কাছ থেকেই ক্রয় করে থাকে, ফলে এই কর বৃদ্ধির প্রভাব উৎপাদিত পণ্যের মূল্যে গিয়ে পড়বে। তবে সমজাতীয় এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য কেন্দ্রীয় বন্ডেড গুদাম স্থাপনের যে ঘোষণা এসেছে, তা যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে এই খাতের জন্য ইতিবাচক সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে, এসএমই খাতে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অডিট অ্যাকাউন্টিং চালু করা বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল হতে পারে। এ বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে, যাতে এসএমই উদ্যোক্তারা বাস্তবভিত্তিক এবং সহজ প্রক্রিয়ার আওতায় থাকে।
অন্যদিকে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে কমিশনের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ৫ থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। এই খাত বিকশিত করতে হলে এই হার পুনরায় ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা জরুরি। উল্লেখযোগ্য যে, সম্প্রতি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী, ভ্যাট মাফের সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ৩০ লাখ টাকা করা হয়েছে এবং টার্নওভার ট্যাক্সের স্তর ৩ কোটি টাকা থেকে নামিয়ে ৫০ লাখ টাকায় আনা হয়েছে। ফলে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, বিশেষ করে স্টার্টআপ ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা করের আওতায় পড়বে, যা এই খাতের জন্য নিরুৎসাহজনক। যদিও বাজেটে স্টার্টআপ খাতের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে, দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় এ খাতের জন্য তা খুবই সীমিত। এই তহবিল প্রাথমিকভাবে অন্তত ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা উচিত, যাতে উদীয়মান উদ্যোক্তারা কার্যকর সহায়তা পান।
একদিকে আমরা নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করছি, অন্যদিকে বাজেট নির্দেশনার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। বরং অনেক সাংঘর্ষিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১১৩ ধারার কথা, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন শিল্পে ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া, তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের প্রধান কাঁচামাল যেমন সুতা ও সিনথেটিক ফাইবারের উপরেও ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে, যার ফলে এ খাতের প্রতিযোগিতা বাড়ার বদলে কমবে, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্পের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাজেটে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি, যা বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগ পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মোবাইল ফোন, তামাক, পানীয়ের ওপর প্রযোজ্য ন্যূনতম কর (আইটিএ ২০২৩-এর ধারা ১৬৩-এর উপধারা ৬-এর অধীনে) ভবিষ্যতে সমন্বয়ের বিষয়ে একটি ভালো উদ্যোগ চালু করা হয়েছে, তবে ৩৮টি খাতের (ধারা ১৬৩(২)) বিধান এখনো অফেরতযোগ্য, যা বেসরকারি খাতের জন্য বোঝা হিসেবে কাজ করবে। বাজেটে ৪৪২টি পণ্যের উপর আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক কর হ্রাস করা হয়েছে, যা মূলত কৃষি ও পশুপালন পণ্য যেমন ছাগল বা ভেড়ার গরু ইত্যাদি। স্থানীয় শিল্পের জন্য কিছু পণ্যের ওপর সম্পূরক কর হ্রাস করা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পানীয় জলের উপর ৫ শতাংশ সম্পূরক কর এখনো এই শিল্পগুলোর জন্য একটি বড় বাধা।
রপ্তানি আয় এবং মালবাহী ফরোয়ার্ডারের ওপর নগদ ভর্তুকির উপর উৎস কর কর্তন (টিডিএস) সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে, যা একটি ভালো উদ্যোগ, রপ্তানি উৎসাহিত করার জন্য সমন্বয়যোগ্যতার পরিধি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করা উচিত। গ্রহণযোগ্য ব্যয় হিসেবে পারকুইজিট সীমা ১০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ লাখ টাকা করা হয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের তাদের কর দায় সহজেই গণনা করতে উৎসাহিত করবে।
বিডার নির্দেশিকা অনুসারে জানা যায়, রয়্যালটি এবং কারিগরি জ্ঞানের (অর্থ অধ্যাদেশের ধারা ৪৯) সীমা বার্ষিক টার্নওভারের ৬ শতাংশ অথবা কোম্পানির জন্য নিট মুনাফার ১৫ শতাংশ, যেটি কম, নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি একটি জটিল নীতি যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দ্বারা অর্জিত প্রকৃত নিট মুনাফা অনুসরণ করার জন্য এটি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। বৌদ্ধিক সম্পত্তিভিত্তিক পরিষেবার ওপর টিডিএস টার্নওভারের ১০ শতাংশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে যা আগে ১২ শতাংশ ছিল, আমাদের এটিকে স্বল্পোন্নত দেশীয় উত্তীর্ণের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
১১০টি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, ৬৫টি পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে, তালিকাটি কোথাও প্রকাশিত হয়নি এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। এটি শিগগির প্রকাশ করা উচিত, এবং পরামর্শ শুরু করা প্রয়োজন।
সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে ৬৬২টি পণ্যের ওপর থেকে আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত করা হয়েছে। বিল্ডের একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে ৭৫৩৭টি এইচএস কোডের মধ্যে মোট ৩ হাজার ৪৪৭টি পণ্য বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃক রক্ষিত সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ শুল্ক ব্যান্ডের আওতায় রয়েছে। সর্বোচ্চ সিডি ব্যান্ড অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মোট এইচএস লাইনের ৪৫ দশমিক ৭৪ শতাংশজুড়ে রয়েছে, যেখানে ১ হাজার ৫৭৯টি এইচএস লাইন কৃষি, পশুপালন, হাঁস-মুরগির আওতায় রয়েছে (এইচএস অধ্যায় ১ থেকে ২৫)। এত বিপুল পরিমাণ কর শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে আমরা অবগত নই, স্থানীয় শিল্পের ওপর এর প্রভাব কীরকম পড়বে তাও আমরা বুঝতে পারছি না। যদিও আমদানি ও ব্যবহারযোগ্য নয় এমন বেশ কিছু পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ শুল্ক হ্রাস করার সুযোগ রয়েছে। যেমন শূকরজাত পণ্য, জীবন্ত ঘোড়া, প্রজনন শূকর ইত্যাদি।
মূল্য হ্রাস ২ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। এটা রপ্তানিকারকদের নমুনা আমদানিতে সহায়তা করবে। ৮৪টি পণ্যের ওপর সর্বনিম্ন শুল্ক মূল্য প্রত্যাহার করা হয়েছে যা স্বল্পোন্নত অর্থনীতি থেকে উত্তরণ এবং টিএফএ প্রভাবের দিকে উন্নতির দিকনিদের্শনা দেয়। ন্যূনতম শুল্ক মূল্য পর্যায়ক্রমে বাদ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের টিকে থাকার জন্য কিছু প্রাথমিক সহায়তার প্রয়োজন হবে এবং এই কর্ম পরিকল্পনা এখনই শুরু করা দরকার।
বাজেটে ব্যক্তি করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে ৫ শতাংশ কর স্ল্যাব প্রত্যাহার করা হয়েছে, ফলে চূড়ান্তভাবে করের বোঝা বৃদ্ধি পাবে এবং নির্ধারিত আয়ের ব্যক্তিরা করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধির উপকারিতা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবেন না। তবুও, দেশের জনগণের জন্য সংক্ষিপ্ত ও লক্ষ্যভিত্তিক বাজেট প্রণয়নের জন্য অর্থ উপদেষ্টাকে প্রশংসা জানাতে হয়।
ফেরদৌস আরা বেগম: অর্থনীতিবিদ ও প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে