সরকারের কাছে চাওয়া সুষ্ঠু নির্বাচন, ভারত ইস্যুতে সবার আগে বাংলাদেশ: তারেক রহমান
দুই দশক পর প্রথমবারের মতো কোনো গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচন, সংস্কার প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ বিএনপির দিকনির্দেশনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটির দ্বিতীয় পর্ব মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) প্রকাশ করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, ‘বিষয়টি রাজনৈতিক। এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা চাই, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একইসঙ্গে প্রত্যাশিত ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের’একটি বিষয় আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত কিছু সংস্কারসহ যেই সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এ রকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি যে, উনারা উনাদের উপরে যে মূল দায়িত্ব আছে , সেটি উনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে এটাই উনাদের কাছে আমাদের চাওয়া। স্বাভাবিকভাবে এই কাজটির সৌন্দর্য্য বা কতটুকু ভালো- মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা নির্ভর করবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণের মনে তৈরি হওয়া সন্দেহ প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সঠিক “রোডম্যাপ বা টাইম ফ্রেম” ঘোষণা না করার কারণে প্রাথমিকভাবে এই সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন রোডম্যাপ ঘোষণা করে তাঁর সিদ্ধান্তে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, তখন থেকেই এই সন্দেহ ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে।
এক-এগারোর সরকার বা সেনা-সমর্থিত সরকারের সেই সময়কালকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারেক রহমান এটিকে ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ আখ্যা দেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা দেখেছি সেই সরকার আসলে কীভাবে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যতটুকু রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল-ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে আমরা তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ দেখেছি অর্থাৎ 'ইন দি নেম অফ ডেমোক্রেসি'।’
ভবিষ্যৎ বিএনপির দিকনির্দেশনা প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণ, দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি, একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান-এই দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।
তিনি দৃঢ়ভাবে জানান, ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহিতা তৈরি করা।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান তার দলের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, বিএনপির মূলনীতি একটাই-সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুন্ন রেখে, দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তারেক রহমান তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাইনা না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নিব না।
বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার যেটা ন্যায্য সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বুঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের উপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নিবো না।’
সংস্কার প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হওয়া মতপার্থক্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, বিশেষত এক ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান থাকার সুযোগ প্রসঙ্গে বিএনপির ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ (আপত্তি) নিয়ে কথা বলেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না। এ রকম আরো যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের উপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরাই বলেছিলাম। এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের 'স'-ও তারা বলেননি। তারপরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি 'নোট অফ ডিসেন্ট' দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে সম্মত করতে হবে সবার সাথে তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয় তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
তিনি যুক্তি দেন, গণতন্ত্র মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে, এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।ভিন্নমত থাকা, তাই বিএনপি ভিন্নমত দিলে তা গণতন্ত্রবিরোধী নয়।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ‘৩১ দফা’ নাকি জুলাই সনদকে অগ্রাধিকার দেবে—এ প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা কিন্তু কোন হাইড এন্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সে রকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকতো, মনের ভিতরে থাকতো একটা, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে ওকে অসুবিধা নাই। তারপরে ইনশআল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। আমরা তো যেটা মনে করছি আমরা সেটাই বলছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেখুন, আমরা যদি রিসেন্ট ঘটনা নেপালেও দেখি আপনি দেখবেন ওরা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না, ওরা বলছে, গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় আছে, সংস্কার বলেন বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা আসবে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা আসবে, তারা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে আমরা প্রথমে সেগুলোতে অবশ্যই জোর দিবো। তারপরে জনগণের প্রতি ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে