Views Bangladesh Logo

বিগ ব্যাং, মহাবিশ্ব ও স্ট্রিং তত্ত্ব

কটা কথা খুব প্রচলিত। বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমেই জন্ম হয়েছে মহাবিশ্বের। আসলেই কি তাই? বর্তমান যে প্রচলিত থিওরি আছে, সে অনুযায়ী বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই সময়ের শুরু। এর প্রমাণও আছে ভুরি; কিন্তু বিগ ব্যাং থিওরি একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না- মহাবিস্ফোরণের আগে কী ছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক কসমোলজিস্ট মনে করতেন, এ প্রশ্নটা আসলে উত্তর মেরু বিভ্রমের মতো। উত্তর মেরুতে গিয়ে আরও উত্তরে যাওয়ার চেষ্টা আসলে বৃথা।

১৯২০-এর দশকে যখন মহাবিশ্বের কাঠামো নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন এর পুরোটাই ছিল জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর দাঁড়িয়ে। অবশ্য কোয়ান্টাম বল্যবিদ্যায় সাহায্য করেছে। অর্থাৎ কণাজ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা দিয়ে মহাবিশ্ব, নক্ষত্রের জন্ম, মৃত্যু ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা হতো। এখানে জেনারেল রিলেটিভিটির ছিল মূল ভূমিকা, সহায়ক ছিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। সাধারণ আপেক্ষিকতা বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যাই যদি পদার্থবিজ্ঞানের শেষ কথা হতো, তাহলেই কেবল বিগ ব্যাংকেই সময়ের শুরু হিসেবে ধরা যেত; কিন্তু অন্য প্রশ্নটা তুলে দেয় স্ট্রিং থিওরি বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও মনে করা হতো বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমেই সময়ের শুরু হয়েছে। এর আগে সময়ের অস্তিত্ব ছিল না।

কেন ছিল না? কারণ, আমাদের ১৩৮০ কোটি বছরের ইতিহাস যদি পিছিয়ে নিতে শুরু করি, তাহলে এর শেষ হবে একটি উত্তপ্ত ঘন বিন্দুতে। যে বিন্দুতে আসলে পদার্থবিজ্ঞানের সব আইন ভেঙে পড়ে। সেই বিন্দুটাকে বলে সিঙ্গুলারিটি। ১৯৬০-এর দশকে স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ এই সিঙ্গুলারিটির তত্ত্ব দেন। সিঙ্গুলারিটি এমন বিন্দু, যেখানে মহাবিশ্বের সব ভরশক্তি আটকে ছিল, তারপর একসময় প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে বস্তুগুলো আলাদা হয়ে যায়। স্থানকালের জন্ম হয়, জন্ম হয় মহাবিশ্বের। তারপর দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে মহাবিশ্ব।

বিজ্ঞানীদের কাছে সিঙ্গুলারিটি অস্বস্তিকর বিষয়। যেখানে মহাবিশ্বের কোনো আইনই চলে না, সেখানে আপনার করার কিছুই থাকে না। বিগ ব্যাংয়ের সময়কার সিঙ্গুলারিটি প্রায় বাতিলের খাতায় পড়ে গেছে। তাই সিঙ্গুলারিটিতেই সময়ের শুরু এ কথা বলতে এখন পদার্থবিজ্ঞানীদের অস্বস্তি লাগার কথা। আর অস্বস্তিটা তৈরি করেছে স্ট্রিং থিওরি।

বর্তমানে ‘থিওরি অব এভরিথিং’ বা সব কিছুর তত্ত্ব হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে স্ট্রিং থিওরি।
কণাজগৎ থেকে মহাজগৎ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, কসমোলজি ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের সব সমস্যার সমাধান আছে এই তত্ত্বে। আইনস্টাইনের বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতার ব্যাখ্যা যেমন স্ট্রিং থিওরিতে মেলে, তেমনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত আইনের ব্যাখ্যাও দিতে পারে স্ট্রিং তত্ত্ব। তাই পরীক্ষামূলক কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া না গেলেও এই তত্ত্বটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সর্বাত্মক তত্ত্ব হওয়ার দৌড়ে।

স্ট্রিং তত্ত্ব বিগ ব্যাংয়ের সিঙ্গুলারিটিকে খারিজ করে দেয়। বরং এই তত্ত্ব বলে, মহাবিশ্বের জন্ম হলো আগের আরেকটি অবস্থার বা ঘটনার ফল। সেই ঘটনা কী- সেটা আমরা এখনো জানি না। আগে যেমন বলা হতো, বিগ ব্যাংয়ের আগে সময়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মানেই হয় না; কিন্তু স্ট্রিং থিওরি আপনাকে সেই নিষিদ্ধ বাউন্ডারি টপকানোর স্বাধীনতা দিচ্ছে।

ইনফ্লেশন বা স্ফীতিতত্ত্ব নামে আরেকটি তত্ত্ব আছে। সেই তত্ত্ব বলে জন্মের খুব স্বল্প সময় পর হঠাৎ মহাবিশ্ব ভয়ংকর ভাবে স্ফীত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা বন্ধও হয়ে যায়; কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। মহাবিশ্বেএক ধাক্কা কোটি কোটি কোটি কোটি গুণ বেড়ে যায়। ইনফ্লেশন তত্ত্বমতেও মহাবিশ্বের জন্ম আসলে বিগ ব্যাং থেকে। এই তত্ত্ব বলে মহাবিশ্বের জন্ম শূন্য থেকেই। তাই বিগ ব্যাং থেকেই সময় শুরু ধরা হচ্ছে; কিন্তু কিছু প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। ইনফ্লেশন কীভাবে ঘটেছিল, ইনফ্লেশন ঘটার জন্য এত বিপুল পরিমাণ শক্তির জোগান এলো কোত্থেকে?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে একটা একটা প্রশ্ন তখন উঁকি দেয় বিজ্ঞানীদের, যদি বিগ ব্যাংয়েই সময়ের শুরু না হয়, খানিকটা আগে থেকে যদি মহাবিশ্বের জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়, তাহলে মহাবিশ্বের প্রাথমিক বস্তুগুলো (আদতে শক্তি) বিরাট ইনফ্লেশনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে, এবং নিজেদের প্রস্তুত করে নিতে পারবে ইনফ্লেশনের জন্য। কথা হচ্ছে বিগ ব্যাংয়ের আগেও যদি কিছু ঘটে থাকে, সেটা কীভাবে ঘটল?
আসলে এ প্রশ্নের ব্যাখ্যার জন্য দরকার ছিল সাধারণ আপেক্ষিতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মেলবন্ধন। অর্থাৎ একটা সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম গ্রাভিটি বা থিওরি অব এভরিথিংসের বড্ড দরকার ছিল; কিন্তু মার্কিন বিজ্ঞানী অ্যানের গুথ বা লিন্ডেরা যখন ইনফ্লেশনারিতত্ত্ব দিচ্ছেন, তখন অবশ্য কোয়ান্টাম গ্রাভিটির প্রতিষ্ঠিত কোনো তত্ত্ব ছিল না।

পরে গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি গিয়ে দুটি তত্ত্ব হাজির হয়। একটা হলো স্ট্রিং থিওরি, অন্যটা লুপ কোয়ান্টাম গ্রাভিটি। পরের দুই-তিন দশকে লুপ কোয়ান্টাম গ্র‍্যাভিটি বেশ উন্নতি করে; কিন্তু সত্যিকারের কোয়ান্টাম গ্রাভিটি হওয়ার প্রতিযোগিতায় এর চেয়ে বরং ঢের এগিয়ে আছে স্ট্রিং থিওরি।

স্ট্রিং থিওরির সূত্রপাত হয় ইতালিয়ান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানোর হাতে। ১৯৬৮ সালে তিন এই তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন; কিন্তু তখন ব্যর্থ হন। কিছুদিনের মধ্যেই তত্ত্বটি বাতিল হয়ে যায়। ১৯৮০-এর দশকে আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী নতুন করে স্ট্রিং থিওরি আবার আলোচনায় নিয়ে আসেন। তখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর জেনারেল রিলেটিভিটিকে এক সূত্রে গাঁথার কিছু গাণিতিক পথ আবিষ্কার করে এই তত্ত্ব। তার পর থেকেই এই তত্ত্ব পেতে শুরু করে গ্রহণযোগ্যতা।

স্ট্রিংতত্ত্ব বলে ইলেকট্রন-কোয়ার্কদের মতো মূলকণিকারা আসলে মার্বেলের মতো দেখতে গোলাকার কোনো বস্তু নয়। এগুলো তৈরি কিছু একমাত্রিক স্ট্রিং বা সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে। একমাত্রিক মানে হলো, এসব তন্তুর কোনো প্রস্থ ও পুরুত্ব নেই আছে শুধু দৈর্ঘ্য।
একটা চুড়িকে ঘুরিয়ে মেঝের ওপর ছেড়ে দিলে এটাকে যেমন আমরা চুড়ির মতো দেখি না, দেখি অনেকটা টেনিস বলের মতো। ব্যাপারটা পুরোপুরি অমন না হলেও, বোঝার স্বার্থে স্ট্রিংগুলোকে অমনটা ভাবতে পারেন।
তবে চুড়ি যদি একটা স্ট্রিং হয়, তাহলে এটাকে আমরা বদ্ধ স্ট্রিং বলতে পারি। কারণ এর কোনো মুক্ত প্রান্ত নেই। স্ট্রিং এমন বদ্ধ হতে পারে, আবার একটা সুতার মতোও হতে পারে। সুতার দুই মাথা খোলা বা মুক্ত থাকে। তাই একে খোলা স্ট্রিং বলতে পারি। এই যে সুতা বা চুড়ির মতো স্ট্রিংগুলো কাঁপতে থাকে। এদের কম্পনের ধরনই বলে দেয়, একটা স্ট্রিং কী ধরনের কণায় রূপ নেবে।

এখন হয়তো বলবেন, চুড়ির মতো বদ্ধ লুপের স্ট্রিংগুলোর কম্পন না হয় কিছুটা অনুমান করা গেল, সুতার মতো দুই প্রান্ত খোলা স্ট্রিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সুতার বদলে একটা তারের কথা ভাবুন। এর দুই মাথা যদি কোনো বস্তুর সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে সেই তারে আঘাত করলে কম্পন হবে, যেমনটা হয় একতারাতে, গিটারে কিংবা বেহালায় থাকে; কিন্তু কিন্তু কণাদের স্ট্রিংগুলোর দুই মাথা কোথায় আটকানো থাকে?
আবারও বলছি, স্ট্রিংগুলো তার, সুতা কিংবা চুড়ির মতো বস্তু ভাবলে চলবে না। এগুলো আসলে স্থান-কালের ভেতর লুকিয়ে থাকা এনার্জির স্ট্রিং। তবে কোথায় আটকানো থাকে তার উত্তর এই লেখায়ই পাবেন।

এই যে কম্পনশীল স্ট্রিং, এর সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সম্পর্ক কী?
স্ট্রিং থিওরির জনকেরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়মগুলো প্রয়োগ করেন কম্পনশীল স্ট্রিংগুলোর মধ্য দিয়ে। তাঁরা দেখেন, এসব স্ট্রিংয়ের ঢেউ বা কম্পন আলোর গতিতে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন স্ট্রিংগুলোর নতুন-নতুন বৈশষ্ট্য দেখা যায়। এই ধরনের স্ট্রিংকে আর সাধারণ স্ট্রিং বলার উপায় থাকে না। এদের বলে কোয়ান্টাম স্ট্রিং। যখন স্ট্রিংগুলোর ওপর কোয়ান্টাম প্রভাব কাজ শুরু করে, তখনই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওই বিশেষ আইনটি সক্রিয় হয়ে ওঠে।


কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে আলোক তরঙ্গ নিরবচ্ছিন্ন তরঙ্গ নয়, আলোকশক্তি নির্গত হয় প্যাকেট বা গুচ্ছের মতো করে। শক্তির একেকটা প্যাকেটকে বলে আলোর কণা বা ফোটন। আলোক তরঙ্গকে এর চেয়ে ছোট প্যাকেটে ভাঙা যায় না। তেমনি স্থান ও কালও এমন বিচ্ছিন্ন প্যাকেট বা দানা হিসেবে থাকে। অন্যদিকে স্ট্রিং তাত্ত্বিকরাও বলছেন, স্ট্রিংয়ের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যে আবদ্ধ। চাইলেই একটা স্ট্রিংকে কেটে আরও ছোট ছোট স্ট্রিং তৈরি করতে পারবেন না। সবচেয়ে ছোট স্ট্রিংয়ের দৈর্ঘ্য ১০⁻৩৪ মিটার।

এই ধ্রুবক স্ট্রিংতত্ত্বকে অসীমের হাত থেকে রক্ষা করে, রক্ষা করে শূন্যের হাত থেকেও। কোয়ান্টাম স্ট্রিংগুলোর সাধারণত ভর থাকে না, কিন্তু কৌণিক ভরবেগ থাকে। ব্যাপারটা যাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তাঁদের বলি আলোর কণা ফোটন ভরশূন্য কিন্তু এদের ভরবেগ আছে। স্ট্রিংগুলোরও ভরবেগ আছে। কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কারণেই স্ট্রিংগুলোর ঘূর্ণন জড়তা থাকে। একটা ছোট্ট স্ট্রিং ভর না বাড়িয়ে দুই একক পর্যন্ত কৌণিক ভরবেগ অর্জন করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বলবাহী কণাদের জন্মপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারে এই বৈশিষ্ট্যগুলো।

কোয়ান্টাম স্ট্রিংয়ের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, আমাদের চার মাত্রার বাইরে চিরচেনা আরও কিছু মাত্রা আছে। একটি বেহালার তার তিন মাত্রায় কাঁপে; কিন্তু কোয়ান্টাম স্ট্রিংগুলো কম্পনগুলো তেমন নয়। এরা যেভাবে কাঁপে তখনই সম্ভব, যদি স্থান-কাল স্বাভাবিকের চেয়ে আরও বেশি বাঁকা হয়।


এই ব্যাপারটা কেমন, তার একটা ধারণা দেওয়া যেতে পারে। কাগজের পৃষ্ঠ যদি যে কোনো একদিকে বাঁকানো হয়, সেটাকে মোটামুটি এক মাত্রায় কম্পন হিসেবে দেখানো যায়; কিন্তু কাগজ না হয়ে যদি একটা টিনের শিট হয়। সেটাকে বাঁকিয়ে যদি ঢেউটিন তৈরি করা যায়, এখানে দিমাত্রিক বক্রতা হিসেবে দেখানে যায়; কিন্তু একটা সিলিন্ডারকে ডানে-বাঁয়ে, সামনে পেছনে বাঁকানো যায়, তাহলে সেটা স্থানের তিন মাত্রায় বাঁকানো বলা যায়। সঙ্গে সময় যোগ করলে সেটা হবে চার মাত্রিক বক্রতা; কিন্তু স্ট্রিংতত্ত্ববিদরা দেখলেন, স্ট্রিংগুলো যেভাবে কাঁপছে, সেই কম্পনের ব্যাখ্যা দিতে হলে আসলে স্থানকালের চার মাত্রিক বক্রতা যথেষ্ট নয়। স্থান-কাল তখন আরও বেশি পরিমাণে বেঁকে যায়। সেটা এতটাই, তার ব্যাখ্যার জন্য দরকার স্থানের আরও ছয় মাত্রার বক্রতা।


অর্থাৎ মহাবিশ্বকে আমরা চার মাত্রার ভাবি, এটা আসলে চার মাত্রিক নয়। আরও ছয়টা মাত্রা লুকিয়ে আছে স্থান-কালের ভেতরে।

স্ট্রিংতত্ত্বের আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণী হলো ধ্রুবকের মানগুলোর হেরফের হয়- যেমন, কুলম্বের ধ্রুবক, নিউটনের ধ্রুবক। এগুলোর মান সব জায়গায় এক থাকে বলেই না এদেরকে ধ্রুবক বলে; কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব বলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এদের মান বদলে যেতে পারে। বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে কুলম্বের ধ্রুবক। স্ট্রিং তত্ত্ব বলে, এসব ক্ষেত্রগুলো মহাবিশ্বের অন্যপ্রান্তে হয়তো একটু আলাদা আচরণ করতে পারে, ফলে ধ্রুবকগুলোর মান কমবেশি হতে পারে। কখনো যদি ধ্রুবকের হেরফের পাওয়া যায় কোথাও, তাহলে হয়তো স্ট্রিংতত্ত্বের খুঁটি আরেকটু মজবুত হবে।

এমন আরেকটা ক্ষেত্র আছে। যেটাকে ডিলাটন বলে। এইটাকেই বলা হচ্ছে স্ট্রিং তত্ত্বের বিশেষ মাত্রা। এই ক্ষেত্র সব ধরনের বল ও বলগুলোর মিথস্ক্রিয়ার শক্তি নির্ধারণ করে। এই ক্ষেত্রটা আছে স্থানের বিশেষ মাত্রায়। তাই আগে যে দশমাত্রিক স্থানকালের কথা বিজ্ঞানীরা বলতেন, এর সঙ্গে ডিলাটনের মাত্রাটাও যোগ হবে। তাই মহবিশ্ব হবে মোট এগারো মাত্রিক।


স্ট্রিং তত্ত্বের আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ধর্ম হলো ডুয়ালিটি। ছোট বস্তুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা যেমনটা ভাবি, সেগুলোকে পুরোপুরি বদলে দেয় এই ডুয়ালিটি। এক ধরনের ডুয়ালিটি আছে। ছোট স্ট্রিংগুলো বড় স্ট্রিংয়ের চেয়ে হালকা হয়; কিন্তু যখন ছোট স্ট্রিংগুলো আরও ছোট করতে যাই, তখন স্ট্রিং আবার ভারী হতে শুরু করে।

স্ট্রিং তত্ত্বে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ডুয়ালিটি হলো টি-ডুয়ালিটি বা টার্গেট স্পেস ডুয়ালিটি। এই ডুয়ালিটি বলে, ছোট হোক আর বড়, স্ট্রিং তত্ত্বে যেসব অতিরিক্ত মাত্রার ধারণা আছে, এগুলো সবগুলোর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য এক। স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, স্ট্রিংয়ের এই বৈশিষ্ট্যের কারণ হলো, এরা বিন্দু কণা যেমন, ফোটন, ইলেকট্রন কিংবা কোয়ার্কদের চেয়ে অনেক বেশি জটিলভাবে নড়াচড়া করে।

ধরা যাক, আংটি বা চুড়ির মতো একটা বদ্ধ স্ট্রিং রয়েছে সিলিন্ডার বা রোল করা কাগজের মতো একটা জায়গায় বা স্থানকালে। সেখানে রোলের বৃত্তাকার চেহারটা একটা বাড়তি মাত্রা নির্দেশ করে। স্ট্রিংয়ের গোলাকৃতিটাও আসলে আলাদা একটা মাত্রা।


স্ট্রিংগুলো ডানে-বাঁয়ে, ওপর নিচে, চারপাশে কাঁপতে পারে। তেমনি এগুলো রোলের স্থানকালের চারপাশে ঘুরেও আসতে পারে। এমনকী রোলের গায়ে একাধিক বার পেঁচিয়ে যেতে পারে। যেমন করে রাবার ব্যান্ড রোল করা কোনো কাগজকে পেঁচিয়ে রাখতে পারে। এটাই হলো টি-ডুয়ালিটি।

যে কারণে সব ধরনের স্ট্রিংয়ের শক্তি সমান হয়, সেটা দেখে নেওয়া যাক। বড় স্ট্রিং রোলের ওপর পেঁচাতে গেলে বেশি শক্তি দিতে হয়। আবার ছোট রোলের কম্পাঙ্ক অনেক বেশি, তাই তাকেও রোলের মতো ওই স্থানকালের ওপর পেঁচাতে গেলে বেশি শক্তির দরকার হয়। এ কারণেই বড় ব্যাস আর ছোট ব্যাসের স্ট্রিংয়ের শক্তি ও ধর্ম একই হয়।

এক সময় স্ট্রিং তত্ত্ববিদেরা মনে করতেন, টি-ডুয়ালিটি শুধু বদ্ধ লুপের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কারণ এদের বৃত্তাকার চেহারা। তাই এরা বৃত্তের মতো ঘুরতে পারে। অন্য দিকে খোলা স্ট্রিং হলো একটা ছেঁড়া রাবার ব্যান্ডের মতো, যার দুই প্রান্ত খোলা, তাই এদের পক্ষে বৃত্তাকারে ঘোরা সম্ভব নয়; কিন্তু ১৯৯৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জোসেফ পলেচিনস্কি বলেন, টি ডুয়ালিটি খোলা স্ট্রিংয়ের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ, খোলা প্রান্তগুলো স্থানের তিনটি মাত্রার জন্য খোলা থাকে; কিন্তু অন্য সাতটি মাত্রায় প্রান্তগুলো আটকে থাকে, ঠিক যেম একতারার তার ওপর ও নিচের প্রান্তে একতারার সঙ্গে আটকে থাকে। তাই এরা টি-ডুয়ালিটি মেনে চলে। এবং তাই ছোট বড় সব ধরনের খোলা স্ট্রিংয়ের শক্তি, ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য এক।

স্ট্রিংগুলোর ধর্ম ও বৈশিষ্ট্যই বলে দেয় এরা অসীমকে কিংবা শূন্যতা পছন্দ করে না। তাই স্ট্রিংকে কেটে খুব ছোট বিন্দুতে যেমন পরিণত করা সম্ভব নয়, তেমনি স্ট্রিং সংকুচিত হয়েও আয়তনশূন্য অসীম ঘনত্বের কোনো বিন্দুতে পরিণত হবে না কখনো।


যদি মহাবিশ্বের ইতিহাস সময়ের উল্টো দিকে চালানো হয়, তাহলে দেখা যাবে, সময়ের পেছন দিকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বক্রতা মানে স্থানকালের বক্রতা বাড়বে, অর্থাৎ সংকুচিত হবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বক্রতার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছবে। সেই সীমার পর বক্রতা আর বাড়বে না, অর্থাৎ আর সংকোচন হবে না। তার মানে সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছানোর আগেই স্থানকালের সংকোচন থেমে যাবে। যেখানে গিয়ে স্থানকালের সংকোচন সবচেয়ে বা বক্রতা সবচেয়ে বেশি, সেটাই হলো বিগ বিগ ব্যাং। তবে মহাবিশ্বের ইতিহাস এখানেই শেষ (আসলে শুরু) নয়। এরপর আপনি সময়ের পেছন দিকে আরও এগিয়ে যেতে পারেন, সেখানে উল্টো দিকে স্থানকালের প্রসারণ পাওয়া যাবে। অর্থাৎ বিগ ব্যাংয়ের আগেও মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল, সেখান থেকে সংকুচিত হয়ে মহাবিশ্বের বিগ ব্যংয়ের পর্যায়ে এসেছে।

তাহলে বিগ ব্যাংয়ের আগে কি আরেকটা মহাবিশ্ব ছিল? আর সেই মহাবিশ্বেই কি সংকুচিত হয়ে বিগ ব্যাংয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল? আসলে এর উত্তর জানতে হলে বিগ ব্যাংয়ের সময়কার পরিস্থিতিটা কেমন ছিল সেটা জানতে হবে; কিন্তু সে সময়কার অবস্থা ছিল ভয়াবহ রকমের অস্থিতিশীল। সেখানকার সমীকরণগুলো সমাধান করা সম্ভব হয়নি আজও। তাই বলে বিজ্ঞানীরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকার বান্দা নন।

স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা দুটো সম্ভাব্য মডেল দাঁড় করিয়েছেন প্রাক বিগ ব্যাংয়ের। একটার নাম প্রি-বিগ ব্যাং মডেল। এটি দাঁড় করিয়েছিলেন ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল ভেনেজিয়ানো, তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে। এই মডেলটি টি-ডুয়ালিটি ও সময়ের বিপরীতমুখী প্রতিসাম্যকে এক করে। এই প্রতিসাম্য অনুযায়ী পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো সময়ের সামনে ও পেছনে উভয়দিকেই সমানভাবে কাজ করে। এ মডেল দেখায় বিগ ব্যাংয়ের পাঁচ সেকেন্ড পর মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছিল, বিগ ব্যাং থেকে সময়ের বিপরীত দিকে বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পাঁচ সেকেন্ড আগেও তা সময়ের উল্টো দিকে প্রসারিত হচ্ছিল। বিগ ব্যাংয়ের আগে প্রসারণের হার অনেক বেশি ছিল; কিন্তু বিগ ব্যাংয়ের পরে সেই হার ছিল অনেক কম। অর্থাৎ এই মডেল বলে বিগ ব্যাং আসলে মহাবিশ্বের সূচনাকাল ছিল না, সময়ের সূচনাকালও ছিল না। অর্থাৎ বিগ ব্যাংয়ের আগেও মহাবিশ্বের এবং সময়ের অস্তিত্ব ছিল।

তবে এই মডেল ইনফ্লেশন তত্ত্বকে সমর্থন করে; কিন্তু গুথ-লিন্ডের চেয়ে এই ইনফ্লেশনের ধরন ছিল আলাদা। গুথ-লিন্ডের ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাং তত্ত্ব বলে ইনফ্লেশন শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের ১০-৩৩ সেকেন্ড পর; কিন্তু প্রি-ব্যিাং মডেলের হিসাব বলে, মহাবিশ্বের স্ফীতি বা ইনফ্লেশন শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের আগে এবং এটা ছিল স্ট্রিং তত্ত্বের নতুন প্রতিসাম্যের স্বাভাবিক ফলাফল।


এই প্রি-ব্যাং থিওরি সমতার কথা বলে। সমতা কী, এক কথাই বলি। আয়নায় নিজেকে দেখলে কী মনে হয়? নিজের সঙ্গে আয়নার ছবির কোনো পর্থাক্য আছে। পার্থক্য যদি থাকে, তাহলে সেটা ডান ও বাঁ দিকের; কিন্তু আর কোনো পার্থক্য নেই। এটাই আসলে সমতা। প্রি-বিগ ব্যাংয়ের সমতাটাও এমন। বিগ ব্যাংয়ের আগের মহাবিশ্বর বিগ ব্যাংয়ের পরের মহাবিশ্বের প্রতিচ্ছবি ছিল। অতীতে অনন্তকাল ধরে মহাবিশ্ব টিকে ছিল। তবে বহু আগে মহাবিশ্ব প্রায় শূন্য ছিল। ছিল কিছু দুর্বল শক্তির বিকিরণ ও গ্যাসীয় পদার্থ। প্রাকৃতিক বলগুলোও তখন দুর্বল ছিল। বস্তুগুলো পরস্পরের সঙ্গে কিংবা বিকিরণগুলোর সঙ্গে মিথস্ক্রিয় করত না বললেই চলে। তবে একেবারে মিথস্ক্রিয়া হত না- একথা বলা চলে না।

দুর্বল শক্তির কারণে খুব সামান্য হলেও মিথস্ক্রিয়া করত পদার্থ কণা ও বিকিরণগুলো। এসব মিথস্ক্রিয়াই বলগুলোকে শক্তিশালী করে তোলে। তখন পদার্থগুলো একত্রিত হতে শুরু করে। কোথাও কোথাও পদার্থগুলো ঘনত্ব বাড়ে। কিছু কিছু জায়গায় ঘনত্ব এত বেশি হয় যে বস্তুগুলো প্রচণ্ড মহাকর্ষ বলের দ্বারা একত্রিত হয় ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। সেই অঞ্চল বা ব্ল্যাকহোল মহাবিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। অর্থাৎ মহাবিশ্বটি বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে যায়।

ওইসব ব্ল্যাকহোলের ভেতরে স্থানকাল তাঁর ভূমিকা বদলে ফেলে। ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্র স্থান নয়, তা সময়ের একটি মুহূর্ত। যখন ব্ল্যাকহোলের ভেতরে বস্তুকণা পড়তে শুরু করে, তখন কেন্দ্রের ঘনত্বও বাড়তে থাকে। বস্তু ঘনত্ব, তাপমাত্রা ও স্থানকালে বক্রতা স্ট্রিং তত্ত্বের সক্রিয় সীমায় পৌঁছে যায়, তখন সময়সহ সেখান বস্তুগুলো বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করে। এক সময় বস্তুর ঘনত্ব, তাপমাত্রা ও স্থানকালের বক্রতা আবার কমতে শুরু। এবং সেই মুহূর্তটাকেই আমরা বিগ বিগ ব্যাং হিসেবে দেখি। অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকেই মহাবিশ্বের জন্ম হয়।

ভেনেজিয়ানোদের এই মডেল নিয়ে হই চই পড়ে যায়। সমালোচনার বান ধেয়ে আসে চারপাশ থেকে। সবচেয়ে বড় সমালোচনা আসে ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাংয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আন্দ্রে লিন্ডের কাছ থেকে। তিনি যুক্তি দেখান, এই মডেল তখনই সত্যি হবে যদি ব্ল্যাকহোলগুলো অতি মাত্রায় বড় হয়। স্ট্রিং তত্ত্বের স্কেলের ব্ল্যাক হোল যতটা বড় হওয়া উচিত তারচেয়েও বড় হতে হবে ব্ল্যাকহোলগুলো। সেই সময় কি আদৌ এত বড় ব্ল্যাকহোল তৈরি হওয়া সম্ভাব?
জবাবে ভেনেজিয়ানোর দল বলেছিলেন, ওই সময়ের ব্ল্যাকহোলেগুলো ছিল নানান আকারে- ছোট-বড়-মাঝারি; কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে একটা বিশাল ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে।

শুধু লিন্ডে নন, ফরাসি বিজ্ঞানী থিবল্ট ডামরু ও বেলজিয়ান বিজ্ঞানী মার্কো হেনা আরেকটি প্রশ্ন তোলেন। বলেন, প্রি-বিগ ব্যাং তত্ত্বে বিগ ব্যাংয়ের খুব কাকাছি সময়ে পদার্থ ও স্থানকালের আচরণ ছিল এলোমেলো। এগুলো ঠিক মহাবিশ্বের নিয়মকানুনের সঙ্গে খাপ খায় না? তাহলে সেখান থেকে আজকের মহাবিশ্বের জন্ম কীভাবে সম্ভব?

এই প্রশ্নের জবাবে ভেনেজিয়ানো আরেকটি প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ওই এলোমেলো সময়ে প্রচুর স্ট্রিং হোলও তৈরি হয়েছিল। সেগুলো কোনোটার আকার ছোট কোনোটার আকার খুব বড়। এসব হোলগুলো কিছু ছিল অনেক বড় আর ভারী, ফলে সেগুলো ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট।
অর্থাৎ প্রি-বি ব্যাং মডেল মানলে বিগ ব্যাংয়েই সময় শুরু নয়। আগেও মহা বিশ্ব ছিল, সময় ছিল। আগের কোনো এক ঘটনার ফলই হলো বিগ ব্যাং।

সূত্র: সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান
আবদুল গাফফার রনি: বিজ্ঞান লেখক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ