Views Bangladesh Logo

সাক্ষাৎকার: পর্ব-৩

বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের বাজার এক ধরনের স্যাচুরেটেড মার্কেট

Kamal  Ahmed

কামাল আহমেদএর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার

হুবিধ ও বহুমুখী সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যুগোপযোগী, কার্যকর সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১১ সদস্যের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যাতে গণমাধ্যমের মালিকানা, আয়ব্যয়, বিজ্ঞাপন বাজার, আর্থিক নিরাপত্তা, বিটিভি-বেতার-বাসস সম্পর্কে করণীয়, সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও সুরক্ষাসহ নানা বিষয়ে ২০ দফা সুপারিশ করেছেন কামাল আহমদের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন। এই ২০ দফার অধীনে রয়েছে আরও বেশ কিছু উপদফা। যাতে বিভিন্ন বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

একই সঙ্গে এই বিষয়গুলো কার্যকরে ‘বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন অধ্যাদেশ: ২০২৫’-এর খসড়াও পেশ করেছে কমিশন। এই খসড়া অধ্যাদেশ এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিবেচনাধীন। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা প্রত্যাশা করছেন খুব দ্রুত এই কমিশনের প্রস্তাবনাগুলো আইনি ভিত্তি পাবে। এই কমিশন গঠন, কার্যক্রম, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কামাল আহমেদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ। সেই সাক্ষাৎকার ভিউজ বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় পর্ব:

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার কমিশন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বাজার তথা গণমাধ্যমের আয় নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে। এখানে একটি প্রশ্ন চলে আসে, বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে এত টেলিভিশন মার্কেট আছে কি না? বাংলাদেশে এত টেলিভিশনের দরকার আছে কি না? একই প্রশ্ন, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও। এত পত্রিকা চলার মতো বিজ্ঞাপনের বাজার কী আছে? এটা এফ এম রেডিও এবং অনলাইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অন্যদিকে হাজার হাজার অনিবন্ধিত অনলাইন রয়েছে। তাদের টিকে থাকার জন্য বিজ্ঞাপনের বাজার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

কামাল আহমেদ: বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বাজার এক ধরনের স্যাচুরেটেড মার্কেট। এখানে কোনোভাবেই টেকসই পর্যায়ের সুস্থ প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। কিছু পরিসংখ্যানেই সেটা প্রমাণ হয়। মিডিয়া তালিকাভুক্তির ওপর সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়া না পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ হয়। ঢাকা শহরেই মিডিয়া তালিকাভুক্ত পত্রিকার সংখ্যা ৬০০ এর ওপরে। আমরা হকার্স সমিতি থেকে যাচাই করে দেখেছি সর্বোচ্চ ৫২টির বেশি পত্রিকা বিক্রি হয় না। তাহলে বাকি ৫৪৮টি পত্রিকা ছাপা হচ্ছে কেন? কারও শখ কারও জন্য এটি হাতিয়ার। কিংবা অন্য স্বার্থ আদায়ের জন্য পত্রিকা বের করা হয়।

কেউ এটাকে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে কিছু আয় রোজগারের মওকা হিসেবে নিয়েছেন। যখন বিজ্ঞাপন থাকে, তখন কাগজটা বের করেন। ১০-২০ বা ১০০ কপিই ছাপলেন, যেদিন বিজ্ঞাপন নেই, সেদিন আর ছাপলেন না। অনিয়মিত প্রকাশনা। এভাবে তারা সরকারের সম্পদ, রাষ্ট্রের অর্থে ভাগ বসাচ্ছেন। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হতে পারে না। এভাবে চলতে পারে না। এই ৫৪৮টি পত্রিকা যে বিজ্ঞাপন নিয়ে যাচ্ছে, যেটা তাদের প্রাপ্য না। অন্যায়ভাবে নিচ্ছে। সেটা আপনি যদি পুনর্বণ্টন করতেন ৫২টি কাগজের ক্ষেত্রে, যাদের বাজার আছে, চাহিদা আছে, তাহলে কিন্তু সেই পত্রিকাগুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো। শক্তিশালী হতো।

ভিউজ বাংলাদেশ: যদি নির্দিষ্টভাবে অনলাইনের কথায় আসি...

কামাল আহমেদ: বাংলাদেশে ২০২৫ সালে সাড়ে ৩ হাজার অনলাইন পোর্টাল আছে। এই সাড়ে ৩ হাজার অনলাইন পোর্টালের মধ্যে কত ডজন পোর্টালের নিউজরুম আছে? যা একটা সংবাদমাধ্যমের নিউজরুমের সঙ্গে তুলনীয়? পোর্টালগুলো ওয়ানম্যান আর্মি। সেটা যে কেউ যে কোনোভাবে পোর্টাল করতে পারে। ব্যক্তিগত ব্লগের পোর্টাল থাকতে পারে; কিন্তু সেটাকে আমি গণমাধ্যম হিসেবে গণ্য করতে রাজি না। সেটাতো গণমাধ্যম হিসেবে সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে না। সেই জিনিসগুলো নির্ধারণ করা দরকার। সে কারণে আমরা কিন্তু আমাদের সুপারিশমালার মধ্যে বলেছি, প্রকাশকের যোগ্যতা নির্ধারণ করা উচিত এবং মালিকানার যোগ্যতা নির্ধারণ করা উচিত। আপনার পোর্টালের যদি অনলাইন নিউজ পোর্টালের অনুমতি দিতে হয়, তাহলে সেই অনলাইন পোর্টালের অবশ্যই সংবাদপত্রের সমকক্ষ একটা বার্তাকক্ষ থাকতে হবে। সেই সামর্থ্য না থাকলে অনলাইন পোর্টালের অনুমতি দেওয়া যাবে না।

ভিউজ বাংলাদেশ: আর সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে...

কামাল আহমেদ: আমরা পত্রিকার ক্ষেত্রে বলেছি, ১৯৭৩ সালের প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্টে যে বিধান ছিল, তার আলোকে সরকারের নীতিমালায় আট পাতার একটা পত্রিকা বের করার জন্য কী ধরনের আর্থিক সামর্থ্য এবং অন্যান্য সামর্থ্য থাকা লাগে, সেটার একটা বিস্তারিত আছে। আগে আট পাতা পত্রিকা বের করার জন্য ২ লাখ বা ৫ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হতো। ১৯৮৪ সালে সেটা পুনর্মূল্যায়ন করে ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। এখন যদি আপনি একটা আট পাতার পত্রিকা বের করেন, সেটা বের করার প্রস্তুতি নিতেও তো ১০ লাখ টাকায় হবে না। বেতন তো পরের কথা। আমরা সেজন্য বলেছি, অন্তত বছর দুয়েক পত্রিকা পরিচালনার পরিচালন ব্যয় আছে, এমন সামর্থ্য প্রমাণ করার পরই তাকে দৈনিক পত্রিকার লাইসেন্স দেওয়া যায়।

ভিউজ বাংলাদেশ: বর্তমানে ঢাকা শহরেই ৫০০টির বেশি সংবাদপত্র রয়েছে। যেগুলোর বেশির ভাগই অনিয়মিত। সারা দেশে এই সংখ্যাটা আরও বেশি। যারা একবার লাইসেন্স নিয়েছেন আর ব্যবহার করছেন না বা অনিয়মিত ব্যবহার করছেন নিজেদের স্বার্থে, এই লাইসেন্সগুলো বাতিল করার কী কোনো উপায় নেই?

কামাল আহমেদ: আমরা কমিশনের তরফ থেকে এখনও নিরুৎসাহিত করছি সরকারকে, তারা যেন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করেন। শত ফুল ফুটতে দেওয়ার যে নীতি, সেটা বহাল থাকাই উচিত। যার সামর্থ্য আছে, সে পত্রিকা প্রকাশ করবে, অনলাইন পোর্টাল রাখবে। কিন্তু সেটা গণমাধ্যম কী না, সংবাদমাধ্যম কী না, রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ সুবিধা বা স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য কি না, সেটা নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের আছে এবং সরকার সেটা করবে। সরকারকে সেটা করতে হবে। ওই যোগ্যতার শর্ত প্রতিফলন না করলে সে রাষ্ট্রের কোনো সহায়তা (সাপোর্ট) পাবে না। সেটা বিজ্ঞাপন হোক, আয়কর নীতি হোক, সরকারি কোনো প্রণোদনা হোক। যেভাবেই হোক না কেন, সে রাষ্ট্রের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না। ফলে যারা শখ করে সংবাদপত্র প্রকাশ করেন, তাদের শখ মিটে যাবে। এরপর তারা নিজেরা আপনা-আপনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবেন। সরকারের তো বন্ধ করার দরকার নেই।
(চলবে)

সাক্ষাৎকার গ্রহণে- রাহাত মিনহাজ, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ