Views Bangladesh Logo

তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিশ্বে দ্বিতীয় বাংলাদেশ, ৪৩ বছরে বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি

তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যেখানে আর্দ্রতার জন্য দায়ী ‘অনুভূত তাপমাত্রা’ বেড়েছে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে একই সময়ে রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন রেকর্ড করা হয়েছে। ঢাকার তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।

‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির উপর তাপের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু-সৃষ্ট তাপ কীভাবে দেশকে জনস্বাস্থ্যের দিকে জরুরি অবস্থা এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তার স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) একটি হোটেলে গবেষণার মূল অনুসন্ধানগুলো উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা ইফফাত মাহমুদ ও ওয়ামেক এ. রাজা।

বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে দেশের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেন প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. সৈয়দুর রহমান।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল ছিল বিশ্বজুড়ে নয়টি উষ্ণতম বছর, যেখানে ২০২৩ সাল সবচেয়ে উষ্ণতম হিসেবে স্থান পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, সবুজ আবরণ কমা এবং কংক্রিট-চালিত উন্নয়নের কারণে ক্রমবর্ধমান হারে তীব্র তাপের প্রতিকূল প্রভাবে বাংলাদেশ, বিশেষত এর নগর কেন্দ্রগুলো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং শারীরিক ও মানসিক উভয় রোগের বৃদ্ধির মধ্যে সরাসরি সম্পর্কও দেখায় অনুসন্ধানগুলো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপজনিত ক্লান্তি দেশের বয়স্ক ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে, যেখানে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ঝুঁকি ২৬.৫ শতাংশ বেড়ে যায়। অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী কাশি গ্রীষ্মে ৬ শতাংশ মানুষকে প্রভাবিত করে, যেখানে শীতকালে এই হার ৩.৩ শতাংশ। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় দেশজুড়ে স্বাস্থ্যগত সমস্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায় ২২.৭ শতাংশ। বিশেষত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু নারীদের ডায়রিয়াজনিত রোগও শীতকালের ১.৮ শতাংশ থেকে গ্রীষ্মকালে ৪.৪ শতাংশ বেড়ে যায়।

তীব্র গরমে মানসিক স্বাস্থ্যেরও উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটে। যেমন, গ্রীষ্মে বিষণ্ণতা ২০ শতাংশ বাড়লেও শীতকালে এ হার ১৬.২ শতাংশ। উদ্বেগ বেড়ে যায় ৮.৩ থেকে ১০ শতাংশ। এমনকি তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে উদ্বেগ আরও তীব্র হয়, যথাক্রমে ২৩.৮ শতাংশ ও ৩৭.১ শতাংশ।

বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির অর্থনৈতিক প্রভাবও ভয়াবহ। শুধুমাত্র গত বছরই তাপ-সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর কারণে ২.৫ কোটি কর্মদিবস ক্ষতি হয়েছে। যার ফলে আনুমানিক ১.৩৩ থেকে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা জিডিপির প্রায় ০.৩ থেকে ০.৪ শতাংশ।

গবেষকদের অনুমান, ২০৩০ সালের মধ্যে তাপের কারণে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ৪.৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা তীব্রভাবে কমে যায়, যা দেশের শ্রম-নিবিড় খাতগুলোতে গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করে।

ক্রমবর্ধমান সংকট প্রশমিত করার জন্য, প্রতিবেদনে পাঁচটি মূল সুপারিশের রূপরেখা দেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপে তাপপ্রবাহের প্রতিক্রিয়া জানাতে জাতীয় প্রস্তুতি জোরদার, তাপ-নির্দিষ্ট জরুরি সুবিধা ও হাসপাতালের প্রস্তুতিতে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন, তাপ-সহনশীল আবাসন, শীতল ব্যবস্থা ও ছায়াযুক্ত কর্মপরিবেশের মতো প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তি গ্রহণ, সময়োপযোগী সতর্কতা ও পরিকল্পনা নিশ্চিতে আবহাওয়ার তথ্যব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জলবায়ু অভিযোজনে বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার অ্যাক্সেসসহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও তহবিল নিশ্চিত।

বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, তাপপ্রবাহ এখন আর কোনো মৌসুমী সমস্যা নয়, বরং বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সংকটও। বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ক্ষেত্রে এটি বেঁচে থাকার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে তারা সুপারিশ করেছেন, নগর পরিকল্পনা, সবুজায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও নীতিমালার প্রতিটি স্তরে তাপ সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় বাংলাদেশ এখনও এই ক্রমবর্ধমান সংকটের জোয়ার ঘুরিয়ে দিতে পারে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ