Views Bangladesh Logo

এত পুরস্কার দিয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের মর্যাদা নষ্ট করেছে

রেজাউদ্দিন স্টালিন আশির দশকের অগ্রগণ্য কবি। প্রেম, দ্রোহ, বিপ্লব, প্রকৃতি, রাজনীতি, মানবিকবোধ তার কবিতার প্রধান বিষয়। কবিতার তুলনায় গদ্য লিখেছেন খুব কম। মূলত, তিনি কবিই এবং সারাক্ষণ কবিজীবনই যাপন করেন। পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি কবিতা লিখছেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার ৬৫টি কবিতাগ্রন্থ। এ যাবৎ তার কবিতা ৪২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবিতা রচনার জন্য ২০০৬ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের জন্ম ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর, যশোর জেলায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং সহজ মানুষ। সম্প্রতি তার কবিজীবন এবং বইমেলা নিয়ে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সম্পাদক কামরুল আহসান

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কেমন আছেন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: ভালো আছি।

ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের বইমেলায় আপনার নতুন কী বই প্রকাশিত হচ্ছে?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: এবারের বইমেলায় আমার সম্পূর্ণ নতুন একটি কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে, আমার বেশির ভাগ বইয়ে নাকি পুরোনো বইয়ের দু-একটি কবিতা থাকে। এবার কোনো পুরোনো কবিতা থাকছে না। একেবারেই নতুন। বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ‘কণ্ঠস্বর প্রকাশনী’ থেকে। বইয়ের নাম ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে’।

ভিউজ বাংলাদেশ: মোট কতগুলো কবিতা আছে এ কবিতাগ্রন্থে?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: মোট ৫৪টি কবিতা আছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: এ কবিতাগুলো আপনি কোন সময় ধরে লিখলেন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: কবিতাগুলো লিখেছি আমি ২০২৩ সালের পুরো বছরজুড়ে। একদম ডিসেম্বর পর্যন্ত লিখেছি।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার তো প্রায় পঞ্চাশটির মতো কবিতাগ্রন্থ?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: না, আমার ৬৫টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: ৬৫টি! এটা তো রেকর্ড!
রেজাউদ্দিন স্টালিন: হ্যাঁ, শামসুর রাহমানের বোধহয় ৫৫টি কবিতার বই আছে। আমার টার্গেট আছে মোট ১০১টি কবিতার বই প্রকাশিত হবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: এই যে এত বছর ধরে আপনি কবিতা লিখছেন, এবারের কবিতায় কী পার্থক্য আছে বলে আপনি মনে করেন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: এবারের কবিতার পার্থক্য আমি যদি সহজ করে বলি, আমি সব সময় চেষ্টা করেছি কবিতাকে একেবারে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসতে। এই সময়ে মানুষের মুখের যে ভাষা তাকে তুলে আনতে। একদম সরাসরি মানুষের মুখের কথাকে কবিতায় তুলে আনতে চেয়েছি। এই নামটা দেখেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, এটা কিন্তু মানুষ কথায় কথায় ব্যবহার করে। কেউ কোনো ঝামেলায় পড়লেই বলে, আরে চিন্তা কর না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: এরকম নাম রাখার কারণ কী?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: মানুষ কিন্তু খুব হতাশায় আছে। রাজনীতি-সংস্কৃতি যেভাবে বিপণ্ন হয়ে যাচ্ছে, বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে, মানুষের সামনে তেমন আশা নেই। সারা পৃথিবীতে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি, পারমাণবিক যুদ্ধ হওয়ার আশ, এ থেকে মানুষকে পরিত্রাণ জানানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেই আমার এ কাব্যগ্রন্থের নাম, ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে’।

ভিউজ বাংলাদেশ: কবি হিসেবে আপনি আশাবাদ ব্যক্ত করছেন ঠিক আছে। যদি আপনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিবেচনা করেন তাহলে একদিন কি আসলেই সব ঠিক হবে?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: আমি মার্কসীয় আদর্শে বিশ্বাস করি। ছাত্রজীবনে আমি বামরাজনীতি করতাম। আমি যতটুকু পড়েছি মার্কসবাদ, আমি দেখেছি একটা সাম্যবাদী সমাজ যদি প্রতিষ্ঠা হয় মানুষের কিছুটা শান্তি হবে। মানুষ তার সাধ্যমতো কাজ করবে। প্রয়োজন মতো খাবে। সেখানে একটা মানবিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব। শোষণ-নিপীড়ন অনেক কমানো সম্ভব। মানুষ তার স্বাধীনতার অধিকার পাবে। মানুষ কিন্তু একটা আদর্শ, স্বপ্ন নিয়েই বাঁচতে চায়। তা না হলে মানুষের এ সমাজ এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারতো না। এত বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েও যে মানুষ টিকে আছে, সামনে এগোচ্ছে এ তো আশাবাদীতার জন্য, স্বপ্নের জন্য। আর সবচেয়ে বড় হচ্ছে ভালোবাসা। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কী? আমি বলেছিলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হচ্ছে হৃদয়। ভালোবাসা।

ভিউজ বাংলাদেশ: কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তো মানুষ তার বর্বতার চূড়ান্তরূপ দেখেছে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন: সেই চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে যে মানুষ বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সে তো ভালোবাসার জন্যই। একে অপরকে ভালোবাসার জন্য। নাৎসিদের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নিজেকে রক্ষা করার জন্য। নিজেদের ভালোবাসার জন্য। মানুষ ভালোবেসে যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে অন্যান্য প্রাণী কিন্তু তাই পারে না। তাই অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, মানুষ কিন্তু টিকে আছে। মানুষ টিকে আছে তার ভালোবাসার জোরে।

ভিউজ বাংলাদেশ: সেই পুরোনো প্রশ্নটা যদি আবার জিজ্ঞেস করি, কবিতা কী প্রভাব ফেলে সমাজে?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: কবিতা আসলে মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। আর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মনই। মানুষ যদি এই পৃথিবীর অন্যায়-অবিচার-শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চায়, লড়াই করতে চায় তার মনকে আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর সেই কাজটাই করে কবিতা। আমাদের ভাষা-আন্দোলনের সময় আমরা তা দেখেছি। কবিরাই তো প্রথম, একটি সংকলন বের করলেন, হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায়, ‘একুশের কবিতা’; সেই সংকলনেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আবদুল গাফফার চৌধুরীর সেই অবিস্মরণীয় কবিতা, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি?’। পরে এটা আলতাফ মাহমুদ সুর করেন। গান হয়ে তা লক্ষ-কোটি বাঙালির হৃদয়ে ঢুকে যায়। এই যে একুশের চেতনা এভাবে জাগ্রত হয়, এটাই কিন্তু আমাদের টেনে নিয়ে গেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে। মুক্তিযুদ্ধের দিকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও গান-কবিতা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমার মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি খুব ছোট; কিন্তু, সারাক্ষণ রেডিও কানে লাগিয়ে বসে থাকতাম। তার কারণ কী? মুক্তির গান কবিতা শোনার জন্য। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আমাদের যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছ তার তো কোনো তুলনা হয় না। তারপর ওই যে গান, তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে... শুনলেই রক্ত নেচে উঠত। গান, কবিতা, যে কোনো শিল্প তো এটাই করে। মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। আরও বেশি করে ভালোবাসতে শেখায়।

ভিউজ বাংলাদেশ: পৃথিবীর বহু ভাষায় আপনার কবিতা অনূদিত হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আপনি কীভাবে তৈরি করলেন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: মোট ৪২টি ভাষায় আমার কবিতা অনূদিত হয়েছে। চার-পাঁচটি ভাষায় আমার বই বেরিয়েছে। এটা হয়েছে করোনার সময় আমি বসে বসে পৃথিবীর অনেক কবি ও কবিতা সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। পরে তারা বলল তোমার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠাও। আমাদের ভাষায় অনুবাদ করে ছাপাব। তখন আমি কয়েকজন অনুবাদকের সহযোগিতায় কিছু কিছু কবিতা অনুবাদ করে পাঠালাম। এভাবেই একটা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। আমার কিন্তু হারুকি মোরাকামির সঙ্গেও কথা হয়। উই আর ক্লোজ ফ্রেন্ড।

ভিউজ বাংলাদেশ: আচ্ছা, আপনার তো দীর্ঘ কবিজীবন, আপনার সব অভিজ্ঞতার কথা শুনতে গেলে অনেক সময় দরকার। আমাদের আজকের আড্ডাটা মূলত বইমেলাকেন্দ্রিক। আমরা একটু বইমেলার আলাপে ফিরে যাই। এবার বইমেলায় গিয়েছিলেন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: হ্যাঁ, গিয়েছিলাম দুদিন।

ভিউজ বাংলাদেশ: কেমন লাগছে এবারের বইমেলা?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: একটু অগোছালো লাগছে। জায়গাটা কেমন আঁটসাট। হাঁটাচলার জায়গা কম। আরেকটু খোলামেলা করা যেত।

ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের বইমেলা শুরু থেকেই বাংলা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন: স্বাভাবিক। বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে এখন প্রতি বছরই আলোচনা-সমালোচনা হয়। আমার মনে হয় এতগুলো পুরস্কার দরকার ছিল না। আমাদের সময়ে ছিল মাত্র ৪টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার। এখন তো ১৬ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার। এমন অনেক ক্ষেত্রে পুরস্কার দেয় বাংলা একাডেমি, যা তাদের দেয়ার দরকার নেই। বিজ্ঞান বিষয় পুরস্কার দেয়ার জন্য বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় আছে। শিশু একাডেমি আছে, শিশু সাহিত্য পুরস্কার দেয়ার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কার দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। সবই বাংলা একাডেমিকে দিতে হবে কেন? একাডেমি পুরস্কার পাওয়া তো চারটিখানি কথা না। এত পুরস্কার দিয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের মর্যাদা নষ্ট করেছে। আমি মনে করি, বাংলা একাডেমিকে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, পুরস্কার কমিটিতে কারা কারা থাকেন, তাও অনেকে আগে আগে জেনে ফেলে। ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে, তাদের কাছে গিয়ে ধরনা দেয়। তবে, আরেকটি কথা না বললে নয় যে, পৃথিবীর সব পুরস্কার নিয়েই নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। নোবেল পুরস্কার নিয়েও হয়।

ভিউজ বাংলাদেশ: কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
রেজাউদ্দিন স্টালিন: তার পুরস্কার তিনি ফিরিয়ে দিতেই পারেন। এটা তার ব্যাপার; কিন্তু দশ বছর পরে কেন? যখন পেয়েছেন তখন দিলে একটা অর্থ থাক তো।

ভিউজ বাংলাদেশ: আরেকটি বিষয়, ১৭ কোটি মানুষের দেশ এই বাংলাদেশ, এক মাসের বইমেলায় বিক্রি ১০০ কোটি টাকার কম। অথচ পৃথিবীর অনেক লেখক লিখে ১০০ কোটি টাকার বেশি আয় করেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিন: হ্যাঁ, হারুকি মোরাকামিই অনেক ধনী। তারপর জে কে রাউলিং তো বই লিখে বিলিয়নিয়ার হয়ে গেছে। তারপর পাউলো কোয়েল হো বিরাট ধনী। আমাদের এখানে কোনো লেখক বই বিক্রি করে ধনী হয়নি এর কারণ পাঠক কম। বিদেশে তো সবাই প্রচুর বই পড়েন। বাংলাদেশে পাঠক কজন? তারপর প্রকাশকরা ঠিক মতো টাকা দেয় না। বইয়ের মার্কেটিংও ভালো হয় না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই। অনেক সমস্যা। তবে, হুমায়ূন আহমেদ, মিলন ভাই কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। এখন অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। কোনো লেখক বোধহয় এখন বাংলাদেশে বই লিখে খাওয়ার চিন্তা করে না।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য।
রেজাউদ্দিন স্টালিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ