Views Bangladesh Logo

জীবনের প্রয়োজনে একজন শিল্পীকে অন্য কিছু করতে হয়

Sajal  Ahmed

সজল আহমেদ

জল আহমেদ। কবি, সম্পাদক, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং নান্দনিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘কবি’র প্রকাশক। বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত বইয়ের পাশাপাশি তিনি প্রকাশ করেন কবিতা, প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য ও সিনেমাবিষয়ক বই। ইতোমধ্যে তার প্রকাশনা ঘিরে বাংলাদেশ ও কলকাতায় তৈরি হয়েছে একটি পাঠকগোষ্ঠী। সজল আহমেদের লেখালেখি, প্রকাশনা শিল্প এবং এবারের বইমেলার আয়োজন নিয়ে তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের কামরুল আহসানমাহফুজ সরদার

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। এবার আপনার প্রকাশনী ‘কবি’ থেকে কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে?
সজল আহমেদ:
আমরা ‘কবি’ নামে প্রকাশনী শুরু করি ২০১১ সালে। শুরুতে ‘কবি’ একটি লিটল ম্যাগাজিন ছিল আর আমি ছোটবেলা থেকেই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমাদের প্রথম একটি পত্রিকা ছিল ‘সময়’ নামে পরে আমরা ভাবলাম শুধু কবিতা দিয়ে একটি পত্রিকা করব। কারণ ‘সময়’ পত্রিকাটা সাধারণত বিশেষ সংখ্যা ছাড়া বের হতো না, ফলে সেখানে তরুণ কবিদের স্থান দেয়া যেত না। তারপর আমরা অনেক দিন ‘কবি’ ম্যাগাজিনটি নিয়মিত প্রকাশ করলাম। এক সময় আমাদের মনে হলো, তরুণ কবিদের বই বের হওয়া দরকার। তখন থেকেই ‘কবি’ ম্যাগাজিনটিকে আমরা প্রকাশনীতে রূপান্তর করলাম। প্রথমে আমাদের ইচ্ছে ছিল, আমার এমন কিছু প্রয়োজনীয় বই প্রকাশ করব, যে বইগুলো আগে প্রকাশ হয়েছে; কিন্তু এখন বাজারে নেই। তাই প্রথমে আমরা কবি বিনয় মজুমদারের একটি বই করলাম। তখন বিনয় মজুদমার লিটল ম্যাগাজিনে লিখতেন। আমরা তার বিখ্যাত ‘ফিরে এসো চাকা’ বের করলাম এবং খুব সমাদৃত হলো। তারপর আমরা তার আরও কিছু বই করলাম। আমরা খুলনার বিখ্যাত কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বই করলাম, এরপর খগেন্দ্রনাথ বসুর ‘দৌলতপুরের ইতিহাস’ বের করলাম। যা প্রায় ১০০ বছর পরে বের হলো।

তারপর আমরা বের করলাম ‘প্রথমমুদ্রণ’, মানে বিখ্যাত কিছু বাংলা বই প্রথম যেভাবে বের হয়েছিলা। আমরা সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’, ‘পাগলাদাসু’, ‘হযবরল’, বের করলাম। আমরা অনেকেই জানি, সুকুমার রায় বেঁচে থাকাকালে তার কোনো বই বের হয়নি। তিনি যখন স্কলারশিপ পেয়ে প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকশনে বিলেতে পড়তে গেলেন; কিন্তু পুরোপুরি শেষ না করে ফিরে আসলেন। এবং তার মনে হলো, তার একটি বই বের হওয়া দরকার। তখন ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটা নিয়মিত বের হয়, তো উনি আবোলতাবোলের একটি ডামি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন; কিন্তু কিছুদিন পরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে তার ছেলে সত্যজিৎ রায় এই বইটি বের করে এবং অনেক এডিশিন বের হয়; কিন্তু আমরা প্রথম এডিশনটা আবার ফিরিয়ে আনলাম। যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইটির প্রথম এডিশনাটা অনেক সুন্দর ছিল, আমরা সেটাকে আবার অনেক সুন্দর করে প্রকাশ করেছি। ‘কবি’ আসলে জনপ্রিয় ধারার প্রকাশনী নয়।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনারা এভাবে কেন কাজ করছেন?
সজল আহমেদ:
এটা আমরা একটি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করছি। একটা পাবলিকেশন মানেই যে, শুধু বই বিক্রি করা, পাঠক প্রচুর বই কিনবে এমন নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক তৈরি করা এবং আমাদের প্রকাশনীর যে কোনো বই-ই নির্বাচিত বই।

ভিউজ বাংলাদেশ: এই চিরায়ত ধারার বইগুলো করে কী আপনাদের খরচ উঠে আসে?
সজল আহমেদ:
এটা যে সহজ রাস্তা ছিল তা না। কারণ, এই ধরনের বই কেনার মানুষও কম, তবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের পাঠকরা ধীরে ধীরে ভালো বই পড়তে শিখবেন। যেমন হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ পাঠক কিন্তু অন্য কোনো বই পড়ে না, সে নিজস্ব পাঠক তৈরি করেছে। আবার যে বিনয় মজুমদার পড়বে সে অন্য আরও পাঁচজন কবির বই পড়বে। ফলে আমাদের ভালো পাঠক তৈরি করতে হবে, আর পাঠক তৈরি করাই আমাদের প্রধান কাজ।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার প্রকাশনী থেকে এ যাবৎ কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে?
সজল আহমেদ:
আমাদের এ যাবৎ প্রায় ৪৫০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ২০০ বই রি-প্রিন্ট করা হয়েছে। আমরা তরুণদের বই করছি, সংকলন করেছি।

ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা লক্ষ্য করেছি আপনি দুই বাংলারই কিছু চিরায়ত বাংলা বই খুবই যত্ন করে প্রকাশ করেছেন। এখানে তো বড় একটা আর্থিক ঝুঁকিও রয়েছে।
সজল আহমেদ:
পুরোনো বাংলা বইয়ের প্রতি আমাদের একটা লোভ আছে। মানে ভালো মানের বাংলা সাহিত্যের বই; কিন্তু এতে রয়ালিটির ব্যাপার আছে, কপিরাইটের ব্যাপার আছে, অনেক বই অনেক করে ফেলেছে সেসব বই আর করার সুযোগ নেই; কিন্তু যে সব বইয়ের কপিরাইট নেই যেমন ধরেন আমাদের তিন বন্দ্যোপাধ্যায় বিভূতি, মানিক ও তারাশংকর। তাদের বইগুলো আমরা প্রথম ধরলাম। তারপর রবীন্দ্রনাথের বই, জীবনানন্দ দাশের বই করলাম। যেমন ধরেন রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ এটা আসলে সব শ্রেণির পাঠকই সব সময় পড়ে; কিন্তু এই বইটার এডিশন আমরা এমনভাবে করেছি, যাতে এটা মানুষের দৃষ্টিনন্দন হয়। প্রচ্ছদ, বানান, মুদ্রণ মিলিয়ে আমরা এমন একটি প্রডাকশন করেছি, যেটা আপনি আপনার বেডরুমে রাখবেন এবং বইটা নিয়ে আপনি ঘুরতেও পারবেন। আমরা চিরায়ত ১০০টি বইয়ের একটা তালিকা করেছি, এ যাবৎ ২৫টি বেরিয়ে গেছে আরও তিনটি এই বইমেলায় বের হবে ও বইগুলো যে কতটা দৃষ্টিনন্দন এবং নান্দনিক, তা একসঙ্গে সাজিয়ে রাখলে তা আপনি বুঝতে পারবেন।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনারা তো সত্যজিৎ রায়ের বইসহ বেশ কিছু সিনেমার বই খুব যত্ন করে প্রকাশ করেছেন। পরে সিনেমার আর কোন কোন বিষয় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে।
সজল আহমেদ:
সিনেমার বইয়ের মধ্যে আমরা প্রথমত পূর্ণেন্দু পত্রীর বই করেছি, যিনি একাধারে পরিচালক, প্রচ্ছদশিল্পী ও কবি। তার অসাধারণ কিছু গবেষণামূলক কাজও আছে। আমরা তার ‘কথাপোকথন’ করেছিলাম এবং বছর আমরা অনুমোদন নিয়েই তার আরও দুটি বই করেছি। সিনেমা নিয়ে আমাদের এবার একটা সিরিজি হচ্ছে। সিরিজটার নাম ‘ধ্রুপদী চলচ্চিত্র গ্রন্থমালা’। এটা পৃথিবীর বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের নিয়ে আমরা করছি। এই বইমেলায় এই সিরিজের তিনটি বই বের হবে। যেমন আসছে গদার, ত্রুফো, সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, হিচকক। আমরা আমাদের দেশ থেকেও তিন জনকে নিয়েছি তারেক মাসুদ, আলমগীর কবির এবং জহির রায়হান।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কী মনে করেন এতদিনে আপনাদের একটা পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে?
সজল আহমেদ:
হ্যাঁ, কিছুটা তৈরি হয়েছে। আমরা পৃথিবীব্যাপী বইমেলা করছি, তবে কলকাতাতে বেশ ভালো একটি পাঠক শ্রেণি তৈরি হয়েছে, কলকাতাতে ভালো বিক্রিও হয় এবং বাংলাদেশেও কিছু পাঠক তৈরি হয়েছে। আমরা আশাবাদী তরুণ পাঠকদের কাছে টানতে পেরেছি। বিষয়বস্তুর পাশাপাশি আমাদের ডিজাইন, প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদ ভাবনা, মুদ্রণের কারণে আমরা পাঠকদের কাছে টানতে পারছি। এবং আমাদের নিজস্ব মুদ্রণ ব্যবস্থা থাকার কারণে ছাপার মান ধরে রাখতে পারছি।

ভিউজ বাংলাদেশ: বই মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে আপনার কি ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
সজল আহমেদ:
আমরা ডিজিটাল মার্কেটিং যেমন, ফেসবুক পেজ, ভিডিও কনটেন্ট এবং নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মার্কেটিং এর চেষ্টা করছি। এবং অনলাইনে আমাদের ভালো বিক্রি হচ্ছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা যতটুকু জানি, আপনি একজন চলচ্চিত্রকার, কবি এবং ব্যবসায়ী; কিন্তু আপনার মূল ফোকাসটা কোন দিকে?
সজল আহমেদ:
নবম শ্রেণিতে থাকাকালে আমার সম্পাদনায় লিটল ম্যাগাজিন বের হয় ‘সময়’ নামে। দশম শ্রেণিতে আমার প্রথম কবিতার বই বের হয়। আমি আসলে সারাজীবন কবিই হতে চেয়েছিলাম। তারপর আমি নাটক এবং সিনেমা বানিয়েছে। আমি আসলে শিল্পের ভেতরেই থাকতে চাই; কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে একজন শিল্পীকে অন্য কিছু করতে হয়।

ভিউজ বাংলাদেশ: এ যাবৎ আপনার কতটি বই প্রকাশিত হয়েছে?
সজল আহমেদ:
আমার কবিতার বই আছে পাঁচটি এবং সম্পাদিত বই আছে ১৬টির মতো। এর মধ্যে দুই বাংলার নির্বাচিত গল্পে দেশভাগ আমার উল্লেখযোগ্য একটি সম্পাদনা, যা দুই বাংলায় এখন প্রায় ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য সহযোগী।

ভিউজ বাংলাদেশ: বইমেলার সামগ্রিক আয়োজন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
সজল আহমেদ:
অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অব্যস্থাপনার মাত্রাটা একটু বেশি মনে হচ্ছে। নোংরা পরিবেশ এবং বাথরুমের সমস্যা। আমি বুঝি না, এটা আমাদের দেশের প্রধান একটি আয়োজন এবং বেশ আবেগের একটা জায়গা, অভিজ্ঞ কোনো আর্কিটেকচারকে দিয়ে কিংবা কোনো শিল্পীকে দিয়ে কেন বইমেলার ডিজাইন কর হয় না! অবশ্য এনামুল কবির নির্ঝর দুইবার চেষ্টা করে একটা চেহারা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ।
সজল আহমেদ:
আপনাদেরও ধন্যবাদ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ