তদারকি না করে আর্থিক খাতে অতিরিক্ত লাইসেন্স প্রদানই আসল সমস্যা
২০২৫ সালে প্রায় ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপি নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অধিক-লাইসেন্সপ্রাপ্ত আর্থিক খাতের দেশ। বর্তমানে দেশে রয়েছে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক, ৩৮টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ৭৫০টিরও বেশি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, এর পাশাপাশি ১৩টি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ৯টি পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার এবং ১২টি পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর। এসব প্রতিষ্ঠান চারটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে পরিচালিত- বাংলাদেশ ব্যাংক, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। তবুও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি আশানুরূপ হয়নি। নগরাঞ্চলের একটি বড় অংশসহ জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার বাইরে।
এই অগ্রগতিহীনতার মূল কারণ হলো একটি নীতি-ভ্রান্তি: ‘বেশি লাইসেন্স মানেই বেশি প্রবেশাধিকার।’ এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল মানির মতো উদ্যোগ চালু হলেও আর্থিক খাতের কাঠামো, খরচ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিচ্ছিন্নতা প্রকৃত অন্তর্ভুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। অবশ্যই যে কোনো অর্থনীতিতে পর্যাপ্তসংখ্যক ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা থাকা জরুরি, যাতে একচেটিয়া ব্যবসা বা প্রভাবশালী অবস্থানের অপব্যবহার না ঘটে। কম প্রতিযোগী থাকলে ভোক্তার বিকল্প কমে, সেবার মান নেমে যায় এবং উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও ধরন অর্থনীতির আকার ও ব্যাংকযোগ্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত লাইসেন্স প্রদান অদক্ষতা ও অতিরিক্ত ব্যয় সৃষ্টি করে; কিন্তু তাতে প্রবেশাধিকার বা সেবার মান তেমন বাড়ে না।
অতিরিক্ত লাইসেন্সের গোপন খরচ
প্রত্যেক আর্থিক লাইসেন্স একটি ভারী পরিচালন ব্যয় নিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ৬১টি তফসিলি ব্যাংক প্রত্যেকেই ঢাকার ব্যতহবিল বাণিজ্যিক এলাকায় কর্পোরেট সদর দপ্তর, নির্বাহী দল, বিধিবদ্ধ অনুবর্তিতা (কম্প্লায়েন্স) বিভাগ, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও পরিচালনা পর্ষদ রাখতে হয়; কিন্তু এসব কাঠামো খুব কম ক্ষেত্রেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বা উদ্ভাবনে প্রভাব ফেলে। একটি সদর দপ্তর পালনে যে অর্থের প্রয়োজন তা দিয়ে শত শত গ্রামীণ শাখা বা ডিজিটাল সেবা কেন্দ্র চালু করা সম্ভব।
এই বাড়তি খরচ প্রতিষ্ঠান নিজেরা বহন করে না; বরং গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দেয় সুদের হার, ফি ও সার্ভিস চার্জ বাড়িয়ে। ব্যবসার মূল মডেল অপরিবর্তিত: আমানত সংগ্রহ, ঋণ প্রদান ও পেমেন্ট প্রসেসিং। অত্যধিক লাইসেন্স মানে পুনরাবৃত্ত ব্যয়, শেষ ব্যবহারকারীর জন্য বাড়তি সুবিধা নয়। প্রতিযোগিতামূলক খরচ কমানোর বদলে অতিখণ্ডিত কাঠামো সামগ্রিক ব্যবস্থাকে অদক্ষ করে তোলে এবং প্রবেশাধিকারের খরচ বাড়ায়।
খেলাপি সংস্কৃতি ও নিয়ন্ত্রক উদাসীনতা
নীতি ও নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতার আরেকটি বড় লক্ষণ হলো অস্বাভাবিক পরিমাণের খেলাপি ঋণ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশেরও বেশি। এটি শুধু কারিগরি বা কার্যক্রমগত সমস্যা নয়; এটি কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকট।
এর প্রধান কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত স্বার্থসংঘাত, যেখানে ব্যাংকের পরিচালক ও অংশীদারগণ নিজেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেন। এ ধরনের আত্মঘাতী লেনদেন আস্থা নষ্ট করেছে এবং ব্যবসার মূলধন শুষে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক ‘ক্রেডিট স্কোরিং এজেন্সি লাইসেন্স’ উদ্যোগ ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও এটি প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া ফলপ্রসূ হবে না। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা তার মালিকের এ ধরনের সংস্থায় অংশীদারিত্ব (শেয়ার) থাকলে একই সমস্যাই নতুন রূপে পুনরাবৃত্ত হবে।
ডিজিটাল ব্যাংক নাকি কেবল ডিজিটালাইজড ব্যাংক?
ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের সাম্প্রতিক উদ্যোগ পরীক্ষামূলক নীতি প্রবণতার প্রতিফলন, যেখানে কৌশলগত স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। মূল প্রশ্ন হলো: এমন কী করতে পারবে একটি ডিজিটাল ব্যাংক যা সঠিকভাবে ডিজিটালাইজড একটি প্রচলিত ব্যাংক করতে পারবে না?
অধিকাংশ ব্যাংক ইতোমধ্যে মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন সেবা ও এজেন্টের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে। মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা ইতোমধ্যে বিস্তৃত। সঠিক আন্তঃকার্যক্ষম কাঠামো ও নিয়ন্ত্রক সমর্থন থাকলে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানই সাশ্রয়ী ও উন্নত ডিজিটাল সেবা দিতে সক্ষম। নতুন ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স আরেকটি আলাদা খাত সৃষ্টি করে, যেখানে নতুন ব্যয়, মূলধন চাহিদা ও কমপ্লায়েন্সের চাপ তৈরি হয়; কিন্তু মৌলিক ঘাটতি রয়ে যায়।
তদুপরি, সফল ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের পূর্বশর্ত সর্বজনীন ইন্টারনেট প্রাপ্যতা, ডিজিটাল সাক্ষরতা ও সাইবার নিরাপত্তা অবকাঠামো বাংলাদেশে এখনো অপর্যাপ্ত। এসব ঘাটতি না মিটলে ডিজিটাল ব্যাংক উচ্চ ব্যয়সাপেক্ষ ও স্বল্প প্রভাবশালী উদ্যোগে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রাখে। কসমেটিক উদ্ভাবনের বদলে অগ্রাধিকার হওয়া উচিত মূল্য সংযোজন সেবা, আন্তঃকার্যক্ষমতা (যেমন ইউপিআই, আরএএএসটি, পিআই এক্স মডেল) এবং কৌশলগত বৈচিত্র্য।
অগ্রগতির পথ: সম্প্রসারণ নয়, ফলপ্রসূকরণ
আর্থিক খাতে প্রয়োজন বেশি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দক্ষ প্রতিষ্ঠান। কয়েকটি সংস্কার সুফল দিতে পারে:
● অচল বা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে বাতিল করে লাইসেন্সের যৌক্তিকতা নিশ্চিত করা
● দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে ব্যয় কমানো ও মূলধন শক্তিশালী করা
● সমান্তরাল ডিজিটাল কাঠামো তৈরির বদলে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটালাইজ করা
● পর্ষদ পর্যায়ে জবাবদিহি ও শাসনব্যবস্থা জোরদার করা
● স্বার্থমুক্ত ক্রেডিট স্কোরিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত ঋণ গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়ন নিশ্চিত করা
● বৈশ্বিক আর্থিক-প্রযুক্তি প্রবণতা বা ট্রেন্ডের পেছনে না ছুটে আগে কাঠামোগত ঘাটতি মেটানো
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি সুনির্দিষ্ট নীতিগত কাঠামো যা জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশলকে সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি ও নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে। এজন্য নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে সমন্বয়, দূরদর্শী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং পরীক্ষামূলক গবেষণা ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের স্পষ্ট নক্সা প্রয়োজন। এসব সমন্বয় ছাড়া সদিচ্ছাপ্রসূত সংস্কারও নতুন অসঙ্গতি সৃষ্টি করতে পারে।
আবু নাজম ম তানভীর হোসেন: পাবলিক পলিসি অ্যাডভোকেট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে