বিয়ের প্রথম বছরেই ‘ইচ্ছার বাইরে’ গর্ভবতী ৭৩ শতাংশ নারী
বিয়ের মাধ্যমে নতুন জীবনের সূচনা হলেও বাংলাদেশের বহু নারীর জন্য সেই জীবন শুরু হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ, চাপ ও সিদ্ধান্তহীনতার মধ্য দিয়ে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর-বি)-এর এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় উঠে এসেছে, বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পাঁচজনের মধ্যে চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই ৭৩ শতাংশ নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন, যার প্রায় অর্ধেকই ছিল তাদের ইচ্ছার বাইরে।
বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ঢাকায় আইসিডিডিআরবির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত গ্রামীণ ও শহরাঞ্চল নববিবাহিত দম্পতিদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট ও চাহিদা নিরূপণ’ শীর্ষক এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার অর্থায়নে পরিচালিত দুই বছরব্যাপী এই গবেষণাটি নববিবাহিত দম্পতিদের বিয়ের পরবর্তী জীবন নিয়ে দেশে প্রথম দীর্ঘমেয়াদী নিবিড় গবেষণা।
গবেষণায় বলা হয়েছে, দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই নারীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বড় ধরনের হস্তক্ষেপ শুরু হয়। বিয়ের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই ৭৯ শতাংশ নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের অভিজ্ঞতার কথা জানান। চলাফেরা, পড়াশোনা, কর্মসংস্থান, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত—সব ক্ষেত্রেই এই নিয়ন্ত্রণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
গবেষকদের মতে, এই নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে সহিংসতার দিকে নিয়ে যায়। দুই বছরের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী আর্থিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ২৩ শতাংশ মানসিক, ১৫ শতাংশ শারীরিক এবং ১৪ শতাংশ যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। মাত্র ৪ শতাংশ নারী জানান, তারা এই সময়ে কোনো ধরনের সহিংসতার মুখে পড়েননি।
গবেষণায় দ্রুত ও অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের চিত্রও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। মোট অংশগ্রহণকারী নারীদের ৭৩ শতাংশ বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই গর্ভবতী হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ গর্ভধারণ ছিল অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগেই। বিশেষ করে শহরের বস্তি এলাকায় এই সমস্যা আরও প্রকট। সেখানে ৬৮ শতাংশ নারী অন্তত দুই বছর সন্তান নেওয়া পিছিয়ে দিতে চাইলেও বাস্তবে ৬৭ শতাংশ নারী সেই সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে পড়েন। গবেষকদের মতে, গর্ভনিরোধক ব্যবহারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সীমিত ক্ষমতাই এর প্রধান কারণ।
বিয়ের পর নারীদের শিক্ষা ও কর্মজীবনও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। গ্রামে ৬০ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৬ শতাংশ নারী বিয়ের পর পড়াশোনা বন্ধ করেছেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আপত্তি, পারিবারিক সিদ্ধান্ত, বাসস্থান পরিবর্তন, সামাজিক রীতি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আয়মূলক কাজের ক্ষেত্রেও স্বামী ও পরিবারের নিয়ন্ত্রণ নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে, যা পরবর্তী সময়ে সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বলে গবেষকদের অভিমত।
গবেষণায় বাল্যবিবাহের উদ্বেগজনক চিত্রও উঠে এসেছে। অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে গ্রামে ৪৩ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগেই। পুরুষদের মধ্যেও কম বয়সে বিয়ের হার উল্লেখযোগ্য—গ্রামে ১৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৭ শতাংশ পুরুষ ২১ বছরের আগেই বিয়ে করেছেন। কম বয়সে বিয়ে করা নারীদের বড় একটি অংশের বিয়ে পরিবার থেকেই নির্ধারিত হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির প্রধান গবেষক ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা, সহকারী বিজ্ঞানী তারানা-ই-ফেরদৌস এবং রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ। বক্তারা বলেন, বিয়ের পরের প্রথম কয়েক বছরই নারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এই সময়ে সুরক্ষা, সচেতনতা ও স্বাস্থ্যসেবায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জোরদার না হলে সহিংসতা ও অনিচ্ছাকৃত মাতৃত্বের এই চক্র ভাঙা কঠিন হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে