Views Bangladesh Logo

শততম টেস্টে শতক: অদম্য মুশফিকের উদ্যম ও প্রচেষ্টা

R J Hridoy

আর জে হৃদয়

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আছে, যেগুলো খেলাকে ছাড়িয়ে একসময় জাতির স্মৃতিতে পরিণত হয়। তেমনই এক দিন ছিল মিরপুরের সেই সকাল, যখন ব্যাট হাতে মুশফিকুর রহিম শুধু রানই তুলছিলেন না—তুলছিলেন দুই দশকের অধ্যবসায়, প্রতিশ্রুতি ও সংগ্রামের প্রতিটি দাগ। তার শততম টেস্টের সেঞ্চুরি যেন শুধু স্ট্যাটিস্টিক্স নয়, ছিল এক যাত্রার পূর্ণতা।

মুশফিকুর রহিম তার শততম টেস্টে সেঞ্চুরির চূড়ায় উঠেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন। তিনি শুধু দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০ টেস্ট খেলার কীর্তিই গড়েননি, বরং বিশ্বের মাত্র ১১ জন ব্যাটারের সেই বিরল তালিকায় জায়গা করে নিলেন—যারা নিজেদের শততম টেস্টকে শতকে রূপ দিয়েছেন।

প্রায় দুই দশকের পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং অনমনীয় প্রতিশ্রুতির ফসল এই অর্জন শুধু তার ব্যক্তিগত গৌরব নয়—বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের জন্যও এক দৃষ্টান্তমূলক মাইলফলক। মিরপুরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২১৪ বল খেলে তার ১০৬ রানের ইনিংস ছিল অভিজ্ঞতা, ধৈর্য ও নিখুঁত শট সিলেকশনের এক শান্ত অথচ দৃঢ় উপস্থাপন। গ্যালারিও যেন নতুন প্রাণ খুঁজে পেল তার ব্যাটিংয়ে; যেন প্রতিটি রানই তার দীর্ঘদিনের লড়াই, দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলার জীবন্ত নিদর্শন।

এ ইনিংস তাকে সেই অভিজাত ক্লাবের সদস্য করেছে, যেখানে আগে থেকেই আছেন গর্ডন গ্রিনিজ, রিকি পন্টিং, জাভেদ মিয়াঁদাদ, জো রুটের মতো কিংবদন্তিরা। ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য এই কীর্তি যেমন মুশফিকের ব্যক্তিগত আলো, তেমনি দেশের টেস্ট ক্রিকেটের পরিপক্বতারও প্রতীক। তার এই সেঞ্চুরির পর টেস্টে শতকের সংখ্যা দাঁড়াল ১৩—যা তাকে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটারদের কাতারে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

মুশফিকের যাত্রা শুরু হয়েছিল এক স্মরণীয় সূচনায়। ২০০৫ সালের ২৬ মে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে লর্ডসের সবুজ মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার অভিষেক—বাংলাদেশ ক্রিকেটের নবীনতম যোদ্ধার আত্মপ্রকাশ। দলের সবচেয়ে কম বয়সী সদস্য হয়েও তার পরিণত মেজাজ, সাহস ও উইকেটকিপিং দক্ষতা সকলকে অবাক করেছিল। তখন কেউই ভাবতে পারেনি—এই কিশোর একদিন বাংলাদেশের টেস্ট দলের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠবে। সময়ের সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন দেশের টেকনিক্যালি সবচেয়ে পরিপক্ব, মানসিকভাবে সবচেয়ে দৃঢ় ব্যাটারদের একজন। সেই কারণেই তিনি পরিচিত হন—“মিস্টার ডিপেন্ডেবল” নামে। তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি আসে ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে; আর ২০১৩ সালে গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্থায়ীভাবে লিখে দেন তিনি। তিনটি ডাবল সেঞ্চুরির মালিক—এমন কীর্তি এখনো কোনো বাংলাদেশি ব্যাটারের নেই, আর এটি তাকে এশিয়ার সেরা কিপার-ব্যাটারদের কাতারেও এনে দাঁড় করিয়েছে।

টেস্টে তার হাজারো রান যেন ফুটিয়ে তোলে ধৈর্য, সূক্ষ্ম টেকনিক ও কঠোর পরিশ্রমের প্রতিটি স্তর। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এসেছে তার বহু স্মরণীয় ইনিংস। ৯৯ টেস্টে ১৮২ ইনিংসে তার সংগ্রহ ৬,৩৫১ রান—গড় ৩৮.০০, মোকাবিলা করা বল ১৩,১২২, স্ট্রাইক রেট ৪৮.৪, ১২টি সেঞ্চুরি, ২৭টি হাফ সেঞ্চুরি, ৭৪০টি চার, ৩৭টি ছক্কা এবং তার সর্বোচ্চ অপরাজিত ২১৯ রান। এসবই বলে—বাংলাদেশ ক্রিকেটে তিনি স্থিতিশীলতার এক উজ্জ্বল প্রতীক।

শুধু ব্যাট হাতে নয়—উইকেটকিপার হিসেবেও তিনি দুর্দান্ত। তার তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া, নিখুঁত গ্লাভসওয়ার্ক এবং শান্ত উপস্থিতি তাকে দিয়েছে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ড। ১১২টি ক্যাচ, ১৫টি স্টাম্পিং ও ৩টি রান-আউট—তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিশ্বস্ত কিপারদের একজন বানিয়েছে। অধিনায়ক হিসেবেও তিনি দলের রূপান্তরের সময়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ছাপ—যে সময় নেতৃত্ব ছিল চ্যালেঞ্জিং, সেই সময়েও তিনি দলকে দিয়েছেন স্থিরতা, শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের মজবুত ভিত।

বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে কিছু মহাকাব্যিক ইনিংসের কারণে—২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০, ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চোট সামলে করা ১৫৯, আর ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অপরাজিত ২১৯—যা দেশের সেরা টেস্ট ইনিংসগুলোর অন্যতম। প্রতিটি ইনিংস তার মানসিক দৃঢ়তা, ক্রিকেটবোধ এবং টেস্ট ক্রিকেটের গভীরতা বোঝার প্রমাণ।

১০০ টেস্ট—এ নিজেই এক বিরল অর্জন। আর বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যারা এখনও টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পথে, তাদের জন্য এই কীর্তি অসামান্য তাৎপর্যের। মুশফিক প্রমাণ করেছেন—বাংলাদেশি ক্রিকেটারও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে কঠিন ফরম্যাটে সাফল্যের দৃষ্টান্ত গড়তে পারে। তার শততম টেস্টের সেঞ্চুরি শুধু একটি শতক নয়—এটি তার পথচলা, নেতৃত্ব, আত্মনিবেদন ও পেশাদারিত্বের প্রতীক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য এটি হবে এক আলোকশিখা—এক অনুপ্রেরণা।

অগ্রদূত। লড়াকু। টেস্ট ক্রিকেটের সেঞ্চুরিয়ান। মুশফিকুর রহিম—বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকার, যিনি আগামী প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে যাবেন আরও দূর পর্যন্ত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ