রোকেয়া দিবসের আলোচনা সভা
নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী পাসে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি
নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী অবিলম্বে পাসের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবী নারীরা। মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে ‘বেগম রোকেয়া দিবস ২০২৫’-এর আলোচনা সভায় এই দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ মিলনায়তেনে বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্ট ফোরাম ও নারী মৈত্রীর যৌথ আয়োজনে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও আলোচনা সভায় বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্ট ফোরামের পক্ষ থেকে সাংবাদিক মমতাজ বিলকিস, মকবুলা পারভীন, ও রোজী ফেরদৌস কে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।
আলোচনা সভায় জানানো হয়, বেগম রোকেয়া নারীর অধিকার ও নারী নেতৃত্বের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অগ্রপথিক। আজকের এই রোকেয়া দিবসে আমরা স্মরণ করি রোকেয়ার সেই প্রগতিশীল চিন্তা—যে চিন্তা নারীর মুক্তি, শিক্ষার বিস্তার এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এই প্রেক্ষাপটে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনীর দাবি শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয় নয়—এটি নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নারীর অধিকার এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য অপরিহার্য।
সভায় আরো জানানো হয়, বাংলাদেশে ৩০% নারী কর্মস্থলে ও ২১% নারী পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে (সূত্র: গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭)। পাশাপাশি গৃহেও নারীরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বাসায় বাবা-ভাই-স্বামী’র ধূমপান, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ধূমপান, যানবাহনে ও পাবলিক প্লেসে অন্যদের ধূমপানের ফলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ায় এ্যাজমা, স্তন ও ফুসফুস ক্যান্সার এবং গর্ভাবস্থায় জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য মতে, যে সব নারী প্রতিদিন ১ ঘন্টা ধূমপায়ীর সাথে থাকে তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
তামাকের কারণে অসংক্রামক রোগ যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসরোগ, ক্যানসার, কিডনি রোগ এবং আঘাতজনিত রোগ ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টোব্যাকো এটলাস ২০২৫’ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ১৩৫ জন মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৩৫৭টি প্রাণ ঝরে যাচ্ছে তামাকের কারণে।
নারী মৈত্রীর সভাপতি মাসুমা আলমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেব উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক নিলোফার চৌধুরী মনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নিলোফার চৌধুরী মনি বলেন, “নারীদের মধ্যে তামাকের ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান হার নারীস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তামাক কোম্পানিগুলো সারা বিশ্বে নারীদেরকে লক্ষ্যবস্তু করে নারীস্বাস্থ্যকে ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। শুধূমাত্র প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ ধূমপানের কারণেই নয়, তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে নারীদের যুক্ত করার কারণে তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে গর্ভধারনের ক্ষমতা হ্রাস, কম ওজনের বা মৃত শিশু বা অকাল প্রসবসহ নানারকম জটিল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তারা।”
উইমেন জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি ফাহমিদা আক্তার বলেন, “তামাক ব্যবহারজনিত কারণে প্রতিবছর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ৩৯.২ হাজার কোটি টাকা জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্যানুসারে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, অথচ তামাক-জনিত রোগের চিকিৎসা খরচ এবং পরিবেশগত ক্ষতি মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা। তামাকের এই সর্বগ্রাসী আগ্রাসনকে তাই আমরা তামাক মহামারী হিসেবেই গণ্য করছি। এই মহামারী রোধকল্পে প্রয়োজন শক্তিশালী আইন। তাই আমরা অবিলম্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণাণলয় কর্তৃক প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী পাসের দাবি জানাচ্ছি।”
সভাপতির বক্তব্যে মাসুমা আলম বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল-এফসিটিসি’তে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ। তামাকের মহামারী সম্পর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধুমপানমুক্ত পরিবেশ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রণোদনা নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখনও সর্বোত্তম মান অর্জন করতে পারেনি। সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছু পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও এখনও বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী। প্রস্তাবিত সংশোধনীটি পাশ হলে একই সঙ্গে দেশে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পাবে এবং এর মারাত্মক স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে। ”
আলোচনা সভায় বক্তারা বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের ৬টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। সেগুলো হলো—পাবলিক প্লেস এবং গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বাতিল করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, তামাকপণ্যের খুচরা ও মোড়কবিহীন বিক্রয় বন্ধ করা, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, সিগারেট ও অন্যান্য তামাকপণ্যের প্যাকেটের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করা এবং ই-সিগারেট বা ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশু-কিশোর ও তরুণদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন উইমেন জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি ফাহমিদা আক্তার, নারী মৈত্রী তামাকবিরোধী শিক্ষক ফোরামের আহ্বায়ক ড. খালেদা ইসলাম ও নারী মৈত্রী তামাকবিরোধী মায়েদের ফোরাম এর আহ্বায়ক শিবানী ভট্টাচার্য।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে