December 7, 1971
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, সামরিক অগ্রগতি ও মুক্তাঞ্চল বিস্তারে ঐতিহাসিক দিন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ ডিসেম্বর একটি মোড় ঘোরানোর দিন। এই দিনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হানাদারমুক্ত হয় এবং সামরিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। বিজয়ের মাত্র নয় দিন আগে এই দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তার চূড়ান্ত এক শক্তি লাভ করে।
৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই ৭ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির ছিল বাংলাদেশের প্রতি দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এরমাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার মহাদেশে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় হয়। একই সাথে পাকিস্তানের প্রতি আঞ্চলিক সমর্থন কমে যায়; আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমতের সহানুভূতি ও সমর্থন আরও শক্তিশালী হয়।
তৎকালীন সময়ে ভুটানের এই সিদ্ধান্তকে অনেক কূটনীতিক ইতিহাসবিদ “দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন” হিসেবে উল্লেখ করেন।
এদিকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যৌথ বাহিনীর সুপরিকল্পিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ফ্রন্টে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর সেই পতনের দৃশ্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা লাইন একের পর এক ভেঙে পড়ে। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল তলানিতে পৌঁছে। বহু স্থানে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঘাঁটি ত্যাগ করে আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকে।
একই দিনে, ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ রাত ১০টায় আকাশবাণীতে হিন্দি, উর্দু ও পশতু ভাষায় বার্তা দেন। তিনি বলেন—চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত, তাই পাকিস্তান বাহিনী যেন আর প্রাণহানি না বাড়িয়ে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘোষণায় পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে পড়ে এবং শুরু হয় তাদের ছত্রভঙ্গ অবস্থায় পিছিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া।
হানাদারমুক্ত হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও জনপদ:-
মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সমন্বিত অভিযানে দেশজুড়ে মুক্তাঞ্চল দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে। ৭ ডিসেম্বরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি—
১. গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস
গোপালগঞ্জ শহর পাকিস্তানি দখলমুক্ত হয়। দীর্ঘদিনের শোষণ ও নির্যাতনের পর শহরবাসী স্বাধীনতার আনন্দে উল্লসিত হয়।
২. চুয়াডাঙ্গা পুরোপুরি হানাদারমুক্ত
চুয়াডাঙ্গা ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এই দিনে পুরো জেলা হানাদারমুক্ত হয়, যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে আরও সহজ করে তোলে।
৩. নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) মুক্ত
তীব্র লড়াইয়ের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর পাকিস্তানি বাহিনী থেকে মুক্ত হয়। এই বিজয় পূর্বাঞ্চলের মুক্তাঞ্চলকে সম্প্রসারিত করে।
৪. যশোর ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন জনপদ স্বাধীন হয়
যশোরের বর্ডার এলাকা এবং সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা মুক্ত হয়, যার ফলে পশ্চিম ফ্রন্টে পাকিস্তানের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং খুলনা-যশোর করিডরে যৌথ বাহিনীর অনুপ্রবেশ সহজ হয়।
এই সময় দেশের অভ্যন্তরে ও শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত মানুষদের মাঝে বিরাট আশাবাদ তৈরি হয়। সেসময় রেডিও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিজয়ের খবর প্রচার করে সাধারণ মানুষের ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল উঁচু রাখে। একের পর এক এলাকার মুক্তির খবরে দেশজুড়ে মানুষ বিজয়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। শহীদ পরিবার, গৃহবন্দী মানুষ, শরণার্থীরা বুঝতে পারে—যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি আর দূরে নয়।
আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কার্যকর কূটনীতির ফলে বিশ্বসমাজে পাকিস্তানের অবস্থান চাপে পড়ে। ৭ ডিসেম্বরের ভুটানের স্বীকৃতি দেখিয়ে দেয়— বিশ্বের দেশগুলো আর পাকিস্তানের প্রচার ও অপপ্রচারে আস্থা রাখছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী বলে বিশ্বমঞ্চে স্বীকৃতি পাচ্ছে।
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ এক ঐতিহাসিক ও চিরস্মরণীয়—স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের আগমনী দিন। যেদিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ, দেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল মুক্তির সাফল্য, পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়া—সব মিলিয়ে বিজয়ের আলোকে আরও কাছে নিয়ে আসে।
৯ দিন পর, অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর, এই অগ্রযাত্রারই চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে—বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে